মতামত

স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য এই পরিবারের চেয়ে যোগ্য কেউ আছে?

সাবেক রাষ্ট্রদূত আফসারুল কাদেরকে আমি প্রায় চার দশক ধরে চিনি। আশির দশকের প্রথম দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রের আইন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণা করছিলেন। আমি একই সময়ে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ছিলাম।

আমরা বোস্টনে, তিনি সপরিবার পার্শ্ববর্তী শহর মেডফোর্ডে থাকতেন। এ দীর্ঘ সময়ে তাঁর সঙ্গে দেশে-বিদেশে আমার বহুবার অনেক বিষয়ে আলাপ হয়েছে, কিন্তু কখনোই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের অবদানের কথা জানতে পারিনি। তিনি কখনো বলেননি। বেশ কিছুদিন আগে অন্য একজনের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, তাঁর পাঁচ ভাই মুক্তিযোদ্ধা এবং দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

জননীর কথা

রত্নগর্ভা শহীদমাতা রওশন আরা বেগমের গর্ভে মোট আটজন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন এক. ড. আফসারুল কাদের, অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত; দুই. আকরামুল কাদের, অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত; তিন. মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল কাদের; চার. মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল কাদের, পাঁচ. শহীদ ক্যাপ্টেন মির্জা আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম; ছয়. শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহসানুল কাদের, সাত. মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল কাদের এবং আট. এম আতাউল কাদের।

তাঁদের বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদের, ইতিহাসে ডিলিট ডিগ্রিধারী। সন্তান হারানোর ভয় নিশ্চিত জেনেও রওশন আরা বেগম একে একে পাঁচ সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন। দুজন জীবিত ফেরেননি, শহীদ হয়েছেন। তাঁদের হারিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বিশেষ করে তিনি ভাবতেন তাঁর ষষ্ঠ ছেলে আহসানুল কাদের জীবিত আছেন, প্রত্যেক ঈদে তাঁর জন্য নতুন জামা বানাতেন!

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মির্জা আফতাবুল কাদের

১৯৬৬ সালের ১৬ নভেম্বর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ৩৯ পিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে শুরু হয় আফতাবুল কাদেরের সামরিক জীবন। প্রচণ্ড স্মার্ট আফতাব ছিলেন সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী। চমৎকার ইংরেজি বলতেন। তাঁর গলায় ইংরেজি গান শুনে অন্য অফিসাররা তাঁকে হলিউডের বিখ্যাত নায়ক রক হাডসনের নামে ‘রকি’ বলে সম্বোধন করতেন। ১৯৬৯ সালের ১৪ নভেম্বর ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি হয় আফতাবের।

আমাদের জানামতে, স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার জন্য এই পরিবারের চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই। তাই পরিবারটিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি। পরিশেষে শহীদ জননী রওশন আরা বেগম ও তাঁর পরিবার দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন, সে জন্য তাঁদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

’৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে ছুটিতে দেশে এলেন তরুণ আফতাব। ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ চট্টগ্রামে কাজি অফিসে বিয়ে করে ফেললেন তাঁর প্রেমিকা খালাতো বোন জুলিয়াকে। মার্চের ২৫ তারিখ দিবাগত রাত একটায় বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যার নজির সৃষ্টি করল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। রেডিওতে প্রতিরোধ সংগ্রামের কথা জানতে পেরে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন যোদ্ধা আফতাবুল কাদের। সিদ্ধান্ত নিলেন, ফিরে যাবেন না পশ্চিম পাকিস্তানে। সদ্য বিয়ের আংটি হাতে নিয়ে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ২৭ মার্চ সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।

ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে মহালছড়িতে ডিফেন্স নিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়নের ১ কোম্পানি (প্রায় ১৩০ জন) ও ১ হাজার ৫০০ মিজো বিদ্রোহী আক্রমণ হানল ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ও ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালেকুজ্জামানের ডিফেন্সের ওপর। লেফটেন্যান্ট মাহফুজের রিজার্ভ ফোর্স তাদের সাহায্যে এগিয়ে এল। নিজের স্টেনগানে গুলি শেষ হয়ে যায় আফতাবের। শত্রুর গুলিতে আহত সহযোদ্ধার এলএমজিটা হাতে নিয়ে ফায়ার করতে থাকেন।

ডিফেন্সে ট্রেঞ্চ থেকে বের হওয়া মানে শত্রুর হাতে নিজের জীবনটা সঁপে দেওয়া। বিপজ্জনক জেনেও সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে তিনি ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে পড়েন। শত্রু থেকে তাঁর দূরত্ব মাত্র ৫০ গজ! খোলা আকাশের নিচে তিন ম্যাগাজিন খালি করে কাভারিং ফায়ার দেন এই তরুণ ক্যাপ্টেন।

জীবন বাঁচান শতাধিক মুক্তিসেনার! এ আক্রমণের একপর্যায়ে শত্রুর একটি গুলি এসে হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়। সটান করে শরীরের সব শক্তি এক করে এলএমজি হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং বলেন ‘আই হ্যাভ বিন হিট’। সবাই অবিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকায় এবং তিনি এলএমজি হাতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

হাতের এলএমজিটা তিনি শক্ত করে ধরে ছিলেন তখনো। আশপাশের মুক্তিযোদ্ধারা শুনতে পান তাঁর শেষ কথা, ‘মা’। জন্মদাত্রী মায়ের আদর উপেক্ষা করে যে তরুণ কোনো কিছুর আশা না করে যুদ্ধের ময়দানে নির্দ্বিধায় নিজের জীবনটাকে সঁপে দেন, তাঁর কাছে দেশমাতৃকাই তো আরেক মা।

৩১ জানুয়ারি ’৭৪ মাধ্যমে বিএ ১০৫৬১ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহীদকে বীর উত্তম (বিউ) পদক প্রদানের অর্ডার ইস্যু করা হয়। সম্মুখসমরে তাঁকে দ্বিতীয় শহীদ অফিসার ধরা হয়।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহসানুল কাদের

মাত্র ১৯ বছর বয়সে মে মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যুদ্ধ শেষ হলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। তখন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল কাদের ভাই আহসানুলের সন্ধান চেয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপনের জবাবে আহসানুলের একজন সহযোদ্ধা জানান যে কুষ্টিয়ায় তাঁদের সঙ্গে ডেন্টাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত ও পরবর্তী সময় পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক ধৃত ও নিহত হন, তিনিই তাঁদের ভাই আহসানুল কাদের। এর বেশি আর কিছু তিনি জানাতে পারেননি। সম্ভবত দেশজুড়ে অসংখ্য গণকবরের কোনো একটিতে তাঁর শেষ ঠাঁই হয়েছে!

প্রকৌশল ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে সিরাজুল কাদের

ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের পরপরই তাঁর বড় ভাই ইপিইউয়েটের (বর্তমানে বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ পর্বের ছাত্র সিরাজুল কাদের কাউকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ২৮ মার্চ ত্রিপুরার বিলোনিয়ায় পৌঁছান। সেখানে তখনো মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত না হওয়ায় ফিরে আসেন। আবার মে মাসে রাজবাড়ী হয়ে কলকাতা পৌঁছান। পরবর্তী সময় আগরতলায় মেলাঘর ক্যাম্পে মেজর হায়দারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শেষে বিক্রমপুর এলাকায় পাড়াগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে যোগ দেন, অপারেশনে অংশ নেন এবং অন্যদের প্রশিক্ষণ দেন।

পাশবিক নির্যাতনের শিকার রেজাউল কাদের

বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল কাদের দেশের অভ্যন্তরে বিএলএফ দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পাকিস্তানি সেনারা নভেম্বর মাসে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং পাশবিক নির্যাতন চালায়। এমনকি তাঁকে জগন্নাথ কলেজ ক্যাম্পে ফায়ারিং স্কোয়াডের জন্য জড়ো করা হয়। ভাগ্যবশত গেন্ডারিয়ার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় মুক্তিপণ দিয়ে তাঁর পরিবার তাঁর জীবন রক্ষা করে। তিনি ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান।

কিশোর মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল কাদের

এমদাদুল কাদের মাত্র ১৫ বছর বয়সে জুন মাসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি দেরাদুনে মুক্তিবাহিনীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে অপারেশনে অংশ নেন।

স্বাধীনতা পুরস্কার

সাধারণত আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে সম্মুখসমরে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হয়েছে। যত দূর জানা যায়, শহীদ আফতাবুল কাদেরের জন্যও একই খেতাব প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত পেয়েছেন বীর উত্তম খেতাব।

আমাদের জানামতে, স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার জন্য এই পরিবারের চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই। তাই পরিবারটিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি। পরিশেষে শহীদ জননী রওশন আরা বেগম ও তাঁর পরিবার দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন, সে জন্য তাঁদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ