মতামত

হামাসের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আনোয়ার ইব্রাহিম

ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমাবেশে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম
ছবি : রয়টার্স

ফিলিস্তিনিদের প্রতি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের বলিষ্ঠ সমর্থন তাঁর দেশের জন্য নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। এর কারণ, হামাস ও ফিলিস্তিনিদের অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বাইরে থেকে যারা অর্থায়ন করছে, তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার একটি আইন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে।

আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রশাসনের ওপর চাপ ছিল মালয়েশিয়া যেন হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দেয় অথবা হামাসের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের এই চাপেও হামাস বিষয়ে সিদ্ধান্ত বদলাননি ইব্রাহিম।

মালয়েশিয়ার পুলিশ এরই মধ্যে সতর্ক করে দিয়েছে যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দিক থেকে অর্থনৈতিক অন্তর্ঘাত, গুপ্তচরবৃত্তি এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ওপর হুমকি আসতে পারে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়েশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক কালে তেল আবিবের সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে রয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

মালয়েশিয়া মনে করে, হামাস গাজার বৈধভাবে নির্বাচিত সরকার। ২০০৬ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। হামাসের সদস্যরা মালয়েশিয়ার কাজ করতে আসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তাঁরা সেখানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার লক্ষ্যবস্তু হন বলে অভিযোগ আছে।

কিন্তু আনোয়ার ইব্রাহিমের এই অকুতোভয় অবস্থানের পেছনে দেশজ রাজনীতির প্রেক্ষাপটই মূল ভূমিকা পালন করেছে। মালয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী মালেদের (ধর্মীয়ভাবে মুসলিম) সমর্থন যাতে তাঁর ওপর বজায় থাকে, সেটা চান আনোয়ার। তাঁর সরকারের টিকে থাকা এবং সামনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসার ক্ষেত্রে মালেদের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অক্টোবরের শেষ দিকে আনোয়ার সৌদি আরব সফরে যান। সেখানে তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগোচ্ছিল। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন জোরালো করতে তিনি মিসর ও তুরস্ক সফরও করেন। আনোয়ারের এই সফরের বাস্তব কিছু প্রভাবও পড়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার এই সময়ে শুধু বাকচাতুরী করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। কেননা, প্রায় এক বছর বয়সী তাঁর সরকারকে বিরোধী ইসলামপন্থী জোট পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) শক্ত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। আনোয়ার ইব্রাহিমের বহুজাতিক জোট সরকার এবং রক্ষণশীল বিরোধী জোট—দুই পক্ষই গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার প্রতিবাদে বিশাল মিছিল করছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সোলারিস স্ট্র্যাটেজিস সিঙ্গাপুরের জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক বিষয়াদি বিশ্লেষক মোস্তফা আইজুদ্দিন বলেন, ‘ফিলিস্তিন ইস্যুতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সমর্থন দেওয়ার পেছনে তাঁর দেশের ভেতরেই জোরালো প্রেরণা রয়েছে। আনোয়ার নিজেকে তাঁর দেশের জনগণের কাছে একজন শক্তিশালী ও প্রধান রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে হাজির হতে চান, যিনি আমেরিকার রাজনৈতিক চাপেও নতি স্বীকার করেন না।’

গত মাসে পার্লামেন্টে ভাষণ দেওয়ার সময় আনোয়ার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তিনটি কূটনৈতিক নোটে মালয়েশিয়া যাতে হামাসের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করে, সে বিষয়ে “সতর্ক” করেছে। আমি তাদের বলেছি, আমাদের নীতি অনুযায়ী, হামাসের সঙ্গে আগে থেকেই সম্পর্ক রয়েছে এবং সেটা অব্যাহত থাকবে।’

সমালোচকেরা বলছেন, ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে কথা বলায় পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ‘হুমকি’ পাচ্ছেন—এই দাবি অতিরঞ্জিত। ২৪ অক্টোবর কুয়ালালামপুরে এক সমাবেশে আনোয়ার বলেন, ‘ইউরোপ, আমেরিকা ও অবশ্যই ইসরায়েল থেকে সমালোচনার শিকার হচ্ছি এবং কেউ কেউ আমাকে আক্রমণও করতে পারে। আমাদের হুমকি দেওয়ার কথা চিন্তাও করবেন না...আমরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের সঙ্গে আছি।’

ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক সংস্থা মালয়েশিয়া (পিসিওএম)— এই সাংস্কৃতিক সংগঠনটি  কার্যত মালয়েশিয়ায় হামাসের দূতাবাস– এমন অভিযোগও রয়েছে। যদিও মালয়েশিয়ার সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এই সংস্থার সঙ্গে হামাসের নেতাদের যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হামাসের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরাসরি সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরও কিছু দেশ হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে।

২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক মানবিক সহায়তা নিয়ে গাজা সফরে যান। সেখানে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোপ্রধান ইসমাইল হানিয়ার। ২০২০ সালে ইসমাইল হানিয়ার কুয়ালালামপুর গিয়ে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা করেন।

মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি মানবিক তহবিল গঠন করেছেন। গাজা ও পশ্চিম তীরে যুদ্ধের ভুক্তভোগী যেকোনো ফিলিস্তিনের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হবে। ১০০ মিলিয়ন রিঙ্গিত (১ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) তহবিল গড়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।

মুস্তাফা বলেন, হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা না দেওয়ায় মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেটা ভাবা ঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্রদেশ আছে, যারা হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে না। মালয়েশিয়া নীতিগতভাবে একটি অবস্থান নিয়েছে যে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কেউ যেন নাক না গলাতে পারে।
মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি সব সময় অর্থনৈতিক বাস্তববাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।

অনেকে এখন বলছেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রতিবাদী অবস্থান তাঁর সরকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কেননা, আমেরিকান অনেক প্রতিষ্ঠানই চীন ছেড়ে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। আনোয়ার এটা স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নতুন আইন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। দুই দেশের বাৎসরিক বাণিজ্য এখন ১ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো।

৭ নভেম্বর পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে আনোয়ার বলেন, মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর ওপর তাতে প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, একতরফা কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে মালয়েশিয়া সেটা মানবে না।

হামাস ইস্যুতে মালয়েশিয়ার অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা হতাশ হলেও, মুসলিম বিশ্বে মালয়েশিয়ার যে প্রভাব, তার প্রতি যথেষ্ট সচেতন। আনোয়ার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, কোনো দেশ যেন গাজা যুদ্ধকে প্রক্সি সংঘাতের সুযোগ হিসেবে না নেয়। নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করলেও, ইরান ও হিজবুল্লাহর দিকেই যে এই ইঙ্গিত সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

অক্টোবরের শেষ দিকে আনোয়ার সৌদি আরব সফরে যান। সেখানে তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগোচ্ছিল। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন জোরালো করতে তিনি মিসর ও তুরস্ক সফরও করেন। আনোয়ারের এই সফরের বাস্তব কিছু প্রভাবও পড়েছে।

গাজা থেকে হামাসের শাসন পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগোচ্ছে ইসরায়েল। সে ক্ষেত্রে বিদেশে হামাসের অবস্থানকেও তারা লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে।

মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান ১ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের দেশে মোসাদের উপস্থিতি আছে বলে স্বীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে ‘হুমকি’কে হালকাভাবে না নেওয়ার জন্য বলেন।

  • নাইল বোয়ে এশিয়া টাইমসের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত