মতামত

‘তোরাবোরার’ সেই সালাহউদ্দিন দেশে ফিরছেন কবে?  

সালাহউদ্দিন আহমদ
ছবি: সংগৃহীত

আপিলেও খালাস পেলেন তিনি। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরা থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ নিখোঁজ হন। ৬৩ দিন পর ১১ মে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে স্থানীয় পুলিশ সালাহউদ্দিনকে উদ্ধারের পর শিলং সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। কিন্তু তিনি কীভাবে সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ে গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।

বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের অভিযোগে ফরেনার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী সালাহউদ্দিনকে গ্রেপ্তার দেখায় মেঘালয় পুলিশ। একই বছরের ২২ জুলাই ভারতের নিম্ন আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের দায়ে অভিযোগ গঠন করা হয়।

সেই মামলায় ২০১৮ সালের নিম্ন আদালত থেকে সালাহউদ্দিন আহমদ খালাস পান। এরপর ভারত সরকার আপিল করলে তাঁকে সেখানেই থাকতে হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আপিলেও বেকসুর খালাস পান এবং আদালত তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। ফলে সাড়ে ছয় বছর পর সালাহউদ্দিন আহমদ দেশে ফিরতে পারবেন বলে আশা করছেন বিএনপির নেতারা। প্রথম আলোর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘আমি যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরতে চাই।’

কিন্তু তাঁর দেশে ফেরার একটা প্রক্রিয়া আছে। তিনি যেভাবে শিলংয়ে গিয়েছেন কিংবা প্রেরিত হয়েছেন, তাতে বহির্গমনের কাগজপত্র তাঁর কাছে থাকার কথা নয়। কিন্তু তাই বলে কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী দেশে ফিরতে পারবেন না? বাংলাদেশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলেও তো দেশে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের আসামি কিংবা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজলের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, সেটাও হতে পারে। দেশে আসার পর বৈধ কাগজপত্র না থাকার অজুহাতে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো। তারপরও সালাহউদ্দিন তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসতে চান। সেটাই স্বাভাবিক। পরদেশ কখনো নিজের হয় না। যদিও আমাদের অনেক মন্ত্রী-নেতা-এমপি বিদেশে সেকেন্ড হোম বানাতে উদ্‌গ্রীব।

১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন সালাহউদ্দিন। এরপর প্রশাসনের চাকরি ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে তিনি কক্সবাজার থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হন। ভারতে আটকের সময় সালাহউদ্দিন আহমদ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। ভারতে আটকাবস্থায় বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলে তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হন।

সালাহউদ্দিন আহমদের খবরটি পড়ে ২০১৬ সালে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা মনে পড়ল। নদীবিষয়ক একটি সেমিনারে যোগ দিতে ওই বছরের জুলাই মাসে শিলং গেলে জানতে পারি, বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন সেখানে আছেন। স্থানীয় একজন সাংবাদিকের সহায়তায় ১৬ জুলাই তাঁর সঙ্গে দেখা করলে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম: শিলংয়ে ‘নির্বাসিত’ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন: জেলে যেতে হলেও দেশে ফিরতে চান।

আলাপে তিনি বাংলাদেশ, রাজনীতি ও তাঁর নির্বাসিত জীবন নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁর একটি কথা এখনো কানে বাজে: ‘জেলে থাকতে হলেও দ্রুত দেশে ফেরত যেতে চাই।’ তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোয় আমার লেখাটি বেরিয়েছিল ২০১৬ সালের ২১ জুলাই। সেদিনের লেখা থেকে তুলে ধরছি:

পাহাড়ঘেরা শিলং শহরের নানা গলি-উপগলি পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই ‘সানরাইজ রেস্টহাউসে’। তিনতলা ওই হাউসে প্রায় স্থায়ীভাবে বাস করেন একজন ‘বিদেশি অতিথি’।

অভ্যর্থনাকক্ষে নাম লিখে ভেতরে ঢুকতেই দেখি, নিচতলার ছোট্ট বৈঠকখানায় সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরা ‘অতিথি’ গল্প করছেন কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। তাঁরা গণমাধ্যমকর্মী—কেউ ভারতের, কেউ বাংলাদেশের। চোখে চোখ পড়তেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’

এই অতিথির নাম সালাহউদ্দিন আহমদ, বিএনপির অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব। ১৬ মাস আগে তিনি কীভাবে এখানে এসেছেন বা নীত হয়েছেন, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়, সেটি এখন শিলং চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারাধীন।

গত বছরের শুরুতে বিএনপির অবরোধ চলছিল বাংলাদেশে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে তাঁর অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখে। মহাসচিবসহ দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা জেলে বা আত্মগোপনে। এই কঠিন অবস্থায় ‘অজ্ঞাত’ স্থান থেকে প্রায় প্রতি রাতে যাঁর কণ্ঠ শোনা যেত বা বিবৃতি পাওয়া যেত, তিনি সালাহউদ্দিন আহমদ। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। সরকারি দলের নেতারা বলতেন, ‘তোরাবোরা পাহাড়’ থেকে এসব ঘোষণা আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হন্যে হয়ে খুঁজেও ‘ঘোষককে’ পাচ্ছে না।

একদিন হঠাৎ সেই ‘অজ্ঞাত’ স্থান থেকে ঘোষণা আসা বন্ধ হয়ে গেল। বিএনপির নেতারা অভিযোগ করলেন, উত্তরার এক বাসা থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলল, তারা কিছু জানে না।

বেশ কিছুদিন পর খবর এল, শিলংয়ে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখে স্থানীয় লোকজন সালাহউদ্দিনকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান। এরপর চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে ফরেনার্স আইনে মামলা হলো। আদালত তাঁকে জামিন দিলেও বলে দিয়েছেন, তাঁদের অনুমতি ছাড়া শিলংয়ের বাইরে যাওয়া যাবে না।

আশির দশকের শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করে সালাহউদ্দিন আহমদ নিজেই রাজনীতি নিয়ে কথা শুরু করলেন। ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তখন ভদ্র ও মেধাবীরা ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে আসতেন। সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত কেউ নেতা হতে পারতেন না। হেমায়েত হোসেন আওরঙ্গ রাজনীতিতে অনেক প্রভাবশালী হয়েও ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে যেতে পারেননি। ছাত্রদলেও নিরু-শহীদ নেতা হতে পারেননি।

জিজ্ঞেস করি, তাঁর বিরুদ্ধে ফরেনার্স আইনে যে মামলা হয়েছে, তার পরিণতি কী? তিনি বললেন, ‘কী ঘটনা ঘটেছে, সবাই জানেন। এখানকার বিচারব্যবস্থার ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সাক্ষ্য নেওয়া শেষ। ২৭ আগস্ট মামলার পরবর্তী শুনানি।’ তিনি আরও বলেন, মামলার রায়ের পরই তিনি দেশে ফিরে যাবেন, এমনকি যদি তাঁকে দেশে গিয়ে জেলেও থাকতে হয়।

নদীবিষয়ক উৎসবে যোগ দিতে আসা কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি তাঁদের প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন। তবে টিভিতে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ দেননি কাউকে। দু-একজন সাংবাদিক বন্ধু জোর করলে কিছুটা বিমর্ষ কণ্ঠে এই ‘নির্বাসিত’ বিএনপি নেতা বলেন, ‘আপনারা আমাকে আবার জেলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন না।’

বিএনপির রাজনীতিতে শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থাভাজন সালাহউদ্দিনের দিন কাটে অভ্যাগতদের সঙ্গে গল্প করে, গান শুনে, বই পড়ে। দেশে আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তাঁর নিয়মিত কথা হয়। স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যসহ কয়েকজন দলীয় নেতা তাঁর সঙ্গে দেখাও করে গেছেন। মাঝেমধ্যে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা আসেন। এখানে তাঁরা একসঙ্গে ঈদ করেছেন। কিছুটা স্বগতোক্তি করে তিনি বললেন, ‘আমার পরিবার তো এখন “আন্তর্জাতিক” হয়ে গেছে। ছেলে থাকে কানাডায়। স্ত্রী ও মেয়ে ঢাকায়। আর আমি এখানে।’

কথা বলতে বলতেই ঢাকা থেকে একজন টেলিফোন করে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর দলের অবস্থান নিয়ে প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট লিংক করার কথা বললেন। রিপোর্টটি পড়েছেন জানিয়ে সালাহউদ্দিন তাঁর কাছে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলছেন! নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াত নিবন্ধিত দল নয়, তারা নির্বাচনও করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধকরণের মামলাটি কেন এত দিন ঝুলে আছে? সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু তারা তা করছে না কেন?’

দলের সাংগঠনিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, চেয়ারপারসন দল পরিচালনা করলেও নীতিপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা যদি সেটি না করেন, তিনি (চেয়ারপারসন) কী করতে পারেন? তাঁর দাবি, দলের কাউন্সিল হলেও কমিটি তিনি যে অবস্থায় রেখে এসেছেন, সেখানেই আছে।’

এই লেখার পর ৬ বছরে বেশি সময় কেটে গেছে। সেদিন শিলংয়ের এক সাংবাদিক বলেছিলেন, মামলাটি দ্রুত শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আদালত সালাহউদ্দিনকে শাস্তি দিলে তিনি আপিল করবেন আর ছাড়া পেলে সরকার আপিল করবে। বাস্তবেও সেটি ঘটল। প্রথমবার আদালতের রায়ে সালাহউদ্দিন খালাস পেলেও সরকার আপিল করে রায় কার্যকর হতে দেয়নি। আপিলে সালাহউদ্দিন জিতে যাওয়ার পর তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়েছে।

যেই মামলা আপিলে চার বছর ঝুলেছিল, সেই মামলার চূড়ান্ত রায় হওয়ার পেছনে অন্য কোনো বিবেচনা ছিল কি না, এর পেছনে ভারত সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের দেনদরবারেরও বিষয় আছে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অথবা সেই প্রশ্নের জবাব কখনোই জানা যাবে না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি