গুলি চালিয়ে ছাত্রজনতাকে হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী সমাবেশ। ০১ আগস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
গুলি চালিয়ে ছাত্রজনতাকে হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী সমাবেশ। ০১ আগস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।

জুলাই হত্যাকাণ্ড: যত গুম–খুনের বিচার আইসিটির মাধ্যমেই যুক্তিযুক্ত

‘স্যার, গুলি করলে মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায়, বাকিগুলা যায় না। এইটাই হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের আর দুশ্চিন্তার বিষয়।’

জনগণের রক্ষক পুলিশ তাঁর ‘স্যার’, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে শহীদ ছাত্রের মরে পড়ে থাকা ভিডিও দেখাতে দেখাতে যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, তা শোনার পর আপনি যে দল-মত বা আদর্শের লোকই হন না কেন, সেই রক্ষকরূপী ‘ভক্ষক’ আর তাঁর ‘স্যার’-এর বিচার না চেয়ে পারবেন না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান দমন করতে গত ১৬ জুলাই থেকে যেভাবে নির্বিচার আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রী ও অন্যদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, যেভাবে হাজার শিক্ষার্থীকে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে, শিক্ষার্থীসহ শত শত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে, তার পুরো দায় সদ্য পতিত শেখ হাসিনা সরকারের।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর জনগণের যে আকাঙ্ক্ষাটি সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা হচ্ছে গত ১৫ বছরে এই সরকার আমলে খুন ও গুমসহ এ ধরনের যত অপরাধ হয়েছে তার সুষ্ঠু বিচার।

এ ধরনের ঘটনাগুলোর মধ্যে গত ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের শহীদ হওয়াদের হত্যার বিচার এবং গত ১৫ বছরের গুম ও খুনের ঘটনাগুলোর বিচার সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। এসবের বিচার কোন আইনি প্রক্রিয়ায়, সেই বিষয়টি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

নানা মতামতের মধ্যে যে দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে, তা হলো ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন (আইসিটি) এবং ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। এ ছাড়া আলোচনায় আছে গণতদন্ত কমিশন এবং ট্রুথ কমিশনের কথা।

১৯৭৩ সালের আইনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণভাবে বিচারকাজ করা সম্ভব, যেমনটি হয়েছিল ২০১০ সালে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে যাঁরা মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচারকাজ শুরু হয় এই আইনের মাধ্যমে।

এই আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল দুটির রায় নিয়ে নানা বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু এরপরও গত সরকারের সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ফোর্স ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স বা গুমের ঘটনাগুলোর বিচার এই আইনে করা সম্ভব।

এই আইনটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে যেমন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা হয়েছে, ঠিক তেমনি সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে ‘ভিকটিম’-এর সংজ্ঞাও যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু যে কয়টা বিষয় নিয়ে সমালোচনা হয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল, ট্রাইব্যুনালের বেশির ভাগ প্রসিকিউটরদের আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আগের কোনো একাডেমিক বা বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব। যে কারণে প্রতিটি মামলার যুক্তি তৈরি এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে পেশ করার ক্ষেত্রে তাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

এখন যদি আবার এই আইনের অধীনে বিচার শুরু হয়, তাহলে ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক আইনে অভিজ্ঞদের বিচারক, তদন্তকারী ও প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।

যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রসিকিউটরদের প্রয়োজন আরও যে কারণে জরুরি, তা হচ্ছে এই আইনে প্রত্যেক প্রসিকিউটরকে মামলা তদন্ত করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে (ধারা ৮ (২)। এই আইনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ‘ট্রায়াল ইন এবসেনশিয়া’ (ধারা ১০ এ) অর্থাৎ কোনো অভিযুক্ত পলাতক থাকলেও তাঁর বিচার করা সম্ভব।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে আইনটি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত এ কারণে যে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে এই আইনে। তখন যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, যেহেতু বাংলাদেশের পেনাল কোডে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে, তাই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে এই দণ্ড সাংঘর্ষিক নয়। তা ছাড়া এই আইনের ধারা ২০ অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও আদালত অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে অন্য যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল চাইলে ক্ষতিপূরণসহ ঘটনার শিকারদের স্মৃতি ধরে রাখা ও তাদের প্রয়োজনীয় সম্মান দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েও রায় দিতে পারবেন।

এরই মধ্যে ১৭ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সামনে বিচারাধীন ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধন করছেন। তাঁরা এই ট্রাইব্যুনালে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলেছেন। কারণ, তাঁরা মনে করেন, এই ট্রাইব্যুনালের অধীনে যে মামলাগুলো হয়েছে, তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে করা হয়েছে।

কোনো অপরাধকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেই অপরাধের গভীরতার মাত্রা বোঝা যাবে, আর অন্য কোনো অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলে তার গভীরতা বোঝা যাবে না, বিষয়টি তেমন নয়। আইনের সংজ্ঞা বিবেচনায় নিয়ে জুলাই-আগস্ট মাসের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করলেই যুক্তিযুক্ত হবে।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম অনেক দিন ধরে বন্ধ আছে। তাই এই ট্রাইব্যুনালের অধীনে নতুন করে মামলা শুরু করতে হলে নতুন করে বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগ দিতে হবে।

আগেই বলেছি, তাদের হতে হবে আন্তর্জাতিক আইনে অভিজ্ঞ। একই সঙ্গে এই বিচারপ্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে এসব পদে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে, যাঁদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনও ১৬ আগস্টের প্রাথমিক প্রতিবেদনে একটি নিরপেক্ষ ও দক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের ওপর জোর দিয়েছে।

জুলাই-আগস্ট মাসের হত্যাকাণ্ড এবং আগের বিভিন্ন গুম ও খুনের অপরাধগুলো বিচারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)।

তবে আইনটির ১৭(১) ধারা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র সংঘটিত অপরাধের বিচারে অনুপযুক্ত বা অনিচ্ছুক হলেই এই আদালত নির্দিষ্ট অপরাধের মামলা আমলে নেবেন। কিন্তু আমরা এর মধ্যেই জেনেছি যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আইসিসির অধীনে মামলা শুরু হলে সেই মামলার প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক বছর লেগে যায় এবং কখনো এক যুগেরও বেশি। যেহেতু এ আদালতে মামলা চালানো অনেক ব্যয়বহুল, তাই মামলা তদন্ত ও বিচারকাজ চলে অনেক ধীরগতিতে।

তা ছাড়া আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও আইসিসি আদালতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। তাই শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচার নিশ্চিত করতে হলে আইসিটি ট্রাইব্যুনালকে ঢেলে সাজিয়ে তা মাধ্যমেই করা উচিত।

ট্রাইব্যুনাল ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি নতুন গঠিত ‘গণতদন্ত কমিশনের’ রিপোর্টও এ ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করি। শেখ হাসিনা বা অভিযুক্তদের কেউ ভারতে থাকলে তাঁদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কারণ, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তি। এ ছাড়া কেউ দেশের বাইরে চলে গেলে ‘ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন’ নীতির মাধ্যমে যে দেশে অপরাধী ব্যক্তি অবস্থান করবেন, সেই দেশও চাইলে বিচার করতে পারবে।

তবে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, আর তা হলো ‘গণহত্যা’ বলতে সাধারণভাবে আমরা ‘জেনোসাইড’ বুঝলেও আইনের দৃষ্টিতে তা নয়। আইনগতভাবে জেনোসাইড নয়, ‘মাস কিলিং’-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘গণহত্যা’। এবং আন্তর্জাতিক আইনে এই ‘মাস কিলিং’ অপরাধটি ‘ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ বা বাংলায় ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ মধ্যে পড়ে, ‘জেনোসাইডের’ মধ্যে পড়ে না!

জেনোসাইড শব্দটির উৎপত্তি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে পোলিশ-জিউ আইনবিদ রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে প্রথম শব্দটি প্রবর্তন করেন। গ্রিক শব্দ ‘জেনোস’ (রেস বা ট্রাইব) এবং লাতিন শব্দ ‘সাইড’ (কিলিং)—এই দুটিকে এক করে তিনি শব্দটি প্রবর্তন করেন। কাজেই জেনোসাইড বলতে কোনো একটি জাতিকে নিধন করা বোঝায়। এ ছাড়া ‘জেনোসাইড’ প্রমাণ করতে হলে, এই অপরাধ করার ‘ইনটেনশন’ বা অভিপ্রায় প্রমাণ করতে হয়, যা অন্যান্য অপরাধের তুলনায় প্রমাণ করা কঠিন।

মূলকথা হলো, কোনো অপরাধকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেই অপরাধের গভীরতার মাত্রা বোঝা যাবে, আর অন্য কোনো অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলে তার গভীরতা বোঝা যাবে না, বিষয়টি তেমন নয়। আইনের সংজ্ঞা বিবেচনায় নিয়ে জুলাই-আগস্ট মাসের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করলেই যুক্তিযুক্ত হবে।

সবশেষে এটুকু বলতে চাই, গত ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের সময় যে অপরাধগুলো ঘটেছে, তার সুষ্ঠু বিচার প্রয়োজন শুধু সেই সরকারে কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের যেকোনো সরকারের জন্যও যেন তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে, সে জন্যও জরুরি।

আর কোনো সরকার যেন সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ না করে, জনগণের সেবক পুলিশ যেন আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম না করে, দুর্নীতি আর হঠকারিতা যেন মাথা তুলে আর দাঁড়াতে না পারে এই বাংলাদেশে—তা নিশ্চিত করতে এই বিচার করতেই হবে।

  • উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, ইউকে