তাপসের ভাতের এত দাম!

নিজের অফিসে ভালো জাতের ভাতের হোটেল খুলে হারুন দারুণ নাম করেছিলেন। ক্ষুধার বিষয়ে উদার হারুন নাম কামাতে পাতের ভাতের দাম নিতেন না। তাঁর হোটেলে ভাত-জাউ-লাউ সব ফাউ পাওয়া যেত।

ফাউ ভাত খাওয়ার রুচি সবার হয় না। বিশেষ করে যাঁদের কাছে পরের ঘরের ভাতের চেয়ে বউয়ের হাতের ভাতের স্বাদ বেশি, তাঁদের পক্ষে বিবির ভাত ফেলে ডিবির ভাত খাওয়া কঠিন।

নিশি-ভোটে নির্বাচিত এমপি থেকে অস্বাভাবিক কায়দায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) মেয়রের চেয়ারে বসে পড়া এবং তার চেয়ে অস্বাভাবিক কায়দায় চেয়ার ফেলে পালানো মেয়র ফজলে নূর তাপস সেই লাইনের লোক।

তাঁর কাছে ঘরের গরম ভাতের মতো পরম জিনিস আর নেই। ভাত নিয়ে তাপস আপস করেননি।

তাপস ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হলেও থাকতেন উত্তরে। মানী লোক হিসেবে বনানীতে থাকতেন। সেখান থেকে একটি গাড়িতে ফুলবাড়িয়ার অফিসে যেতেন। দুপুরে বাড়ির ভাত আনতে বরাদ্দ ছিল আলাদা গাড়ি

যে গাড়িতে ভাত আনা হতো, সেই গাড়ি অন্য কাজে লাগানো মানা ছিল। ভাতবাহী গাড়ির ফুয়েল খরচ দিনে ছিল আড়াই হাজার; মাসে ৫৫ হাজার, বছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বনানীর বাড়ি থেকে গাড়ি করে ফুলবাড়িয়ায় লাঞ্চ আনানোর যে খরচ, তার সঙ্গে লাঞ্চ বানানোর খরচ যোগ দিলে পিলে চমকে যাবে। দেখা যাবে, একা তাপসের এক বেলার ভাতের দাম পড়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সেই হিসাবে শুধু দুপুরেই এক মাসে তাঁর ভাতের পেছনে গেছে লাখ টাকা। মুজতবা আলীর পণ্ডিত মশাই বলেছিলেন, লাট সায়েবের তিন ঠ্যাংয়ের কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হয় ৭৫ টাকা আর পণ্ডিত মশাইয়ের ‘একুনে আটজনের’ ফ্যামিলির চাল–ডাল তরিতরকারির মতো দরকারি খরচার সরকারি বেতন হিসেবে আসে ২৫ টাকা।

পোশাকে-আশাকে পশ তাপস ডিএসসিসির বস ছিলেন ৫১ মাস। ৫১ মাসে শুধু ভাতের গাড়ির তেলের খরচ দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকা।

এর সঙ্গে চালক ছিল; ভাত বহনকারী বয়-বেয়ারা-বালক ছিল। ভাত–সংশ্লিষ্ট এসব চামচা-হাতার বেতন-ভাতা ছিল।

বনানীর বাড়ি থেকে গাড়ি করে ফুলবাড়িয়ায় লাঞ্চ আনানোর যে খরচ, তার সঙ্গে লাঞ্চ বানানোর খরচ যোগ দিলে পিলে চমকে যাবে।

দেখা যাবে, একা তাপসের এক বেলার ভাতের দাম পড়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সেই হিসাবে শুধু দুপুরেই এক মাসে তাঁর ভাতের পেছনে গেছে লাখ টাকা।

মুজতবা আলীর পণ্ডিত মশাই বলেছিলেন, লাট সায়েবের তিন ঠ্যাংয়ের কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হয় ৭৫ টাকা আর পণ্ডিত মশাইয়ের ‘একুনে আটজনের’ ফ্যামিলির চাল–ডাল তরিতরকারির মতো দরকারি খরচার সরকারি বেতন হিসেবে আসে ২৫ টাকা।

পণ্ডিত মশাইয়ের আটজনের পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের কয়টা ঠ্যাংয়ের সমান, তা তিনি ছাত্রদের বসে আঁক কষে বের করতে বলেছিলেন।

সিটি করপোরেশনের যে কর্মচারীর বেতন ২০-২৫ হাজার টাকা, তিনি লাট সায়েবের তিন ঠ্যাংয়ের কুকুর ও পণ্ডিত মশাইয়ের বেতনবিষয়ক অঙ্কের মতো করে যাদব বাবুর পাটিগণিতে হিসাব করে দেখতে পারেন, মেয়র তাপসের দুপুর ওয়াক্তের কয় থালা ভাতের দাম তাঁর ফ্যামিলির সারা মাসের খরচের সমান।

অঙ্কের ফল চোখে জল ছাড়া অন্য কিছু আনবে বলে মনে হয় না। নগরপিতাকে তখন হয়তো ভাত দেওয়ার মুরোদ না থাকা ‘কিল মারার গোঁসাই’ মনে হতে পারে।

এমপি তাপস ও মেয়র তাপসের অর্থবিষয়ক নীতি এবং দুর্নীতি নিয়ে নানা খবর নানা সময়ে এসেছে। সেগুলো আপাতত ভুলে আলোচনার বাইরে তুলে রাখা থাক।  

আপাতত প্রশ্ন করা যাক, তাপসের এই পাত ভরা ভাতবিলাসের পেছনে কার হাত ছিল? এই ভাতবিলাসে কার সায় আছে।

কার পয়সায় এই ভাতবিলাস? এই টাকা কি তাঁর, নাকি আমার আর আপনার? তিনি পাবলিকের রক্তের দামে কেনা ভাতে দুপুর ওয়াক্তের ভূরিভোজ সেরেছেন।

এখন গদি থেকে সরেছেন। এখন তাঁর মাথায় থাকা ক্ষমতার সে হাতও নাই, তাঁর থালায় সে ভাতও নাই।

জেলের ভাত যাতে খাওয়া না লাগে, সে কারণে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন আগে বেশ বদল করে দেশ ছেড়েছেন তিনি।

এখন তিনি নাকি সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরে ভাতের বদলে শিঙাড়া আর পুরি খাচ্ছেন কি না কে জানে।

তাপস যে ভাতবিলাসের নজির রেখে গেছেন, সেই নজির পাবলিকের সামনে বহুদিন তোলা থাকবে।

ভবিষ্যতে যাঁরা ‘নগরপিতা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের কাছে সানুনয় অনুরোধ, তাঁরা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে–ভাতে’ বলার সময় যেন তাপসের এই পা-পোষ মার্কা ভাতবিলাসকে লজ্জার চোখে দেখেন।

পরের পয়সায় ফুটানো ভাতের ফুটানি দেখাতে গিয়ে তাঁরা যেন হাঘরে–হাভাতের বাড়া ভাতে ছাই না দেন। কোনোমতে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকা ‘নগর-সন্তান’ হিসেবে ভবিষ্যতের ‘নগরপিতার’ কাছে আমাদের এত্তটুকুনই চাওয়া।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin2003@gmail.com