গাজায় নৃশংস যুদ্ধ, দীর্ঘ ও উপর্যুপরি অপরাধমূলক নীতি ইসরায়েলের জন্য আত্মঘাতী ফল বয়ে আনতে পারে। এমনকি এ থেকে শক্তিশালী ইহুদি রাষ্ট্রের অবসানও ঘটতে পারে।
আসলে আত্মরক্ষার নামে গাজায় ইসরায়েলের সুপরিকল্পিত গণহত্যা দেশটিকে নিরাপদ করবে না; বরং এ অঞ্চলে আরও বড় পরিসরে অনিরাপত্তা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। এতে ইসরায়েল আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। যে ভৌগোলিক অঞ্চলে দেশটির অবস্থান, সে অঞ্চলটি মোটাদাগে তাদের জন্য বরাবরই প্রতিকূল ছিল। এই যুদ্ধ তাদের দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার পথে এবার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করল।
ঔপনিবেশিকতা ছেড়ে আর দশটা স্বাভাবিক রাষ্ট্রের মতো আচরণ না করলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের কোনো ভবিষ্যৎ আছে—এটা কখনো মনে হয়নি আমার।
১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে অল্প কিছু সময়ের জন্য এমনও মনে হয়েছিল যে ইসরায়েল হয়তো স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছিল তখন। তারা এ অঞ্চলের ফিলিস্তিনি ও আরব রাষ্ট্রগুলোকে শান্তিপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। ইসরায়েল এমনকি দেশগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তবে প্রতিবারই তাদের ঔপনিবেশিক চেহারা বেরিয়ে পড়ে। দখলদারির অবসান ঘটিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের হাজারো সুযোগ তারা নষ্ট করেছে। ইসরায়েলি কূটনীতিক অ্যাবা এবান একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ইসরায়েল সুযোগ নষ্ট করার সুযোগ কখনো নষ্ট করে না।
ইসরায়েল দখলদারির অবসান ঘটানোর পরিবর্তে ফিলিস্তিনে তাদের উপনিবেশ সম্প্রসারণের প্রকল্পকে আরও বড় করেছে। ফিলিস্তিনের কাছ থেকে চুরি করা ভূমিতে ইহুদি বসতি ক্রমে বেড়েছে। এই অবৈধ বসতিতে পৌঁছাতে ইসরায়েল বিশেষ বাইপাস সড়ক ও অন্যান্য প্রকল্প নিয়েছে। তারা সেখানে দুই ধরনের ব্যবস্থা জারি রেখেছে। যা কিছু উন্নত তা ইহুদিদের জন্য, আর যা কিছু অনুন্নত তা ফিলিস্তিনিদের।
দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি অ্যাপারথেইডের অবসান ঘটেছে, আরেকটির উত্থান আমরা দেখলাম ফিলিস্তিনে।
ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় শান্তি অপসৃত হয়। ফলে ইসরায়েল আরও বেশি ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে দিন দিন। এমনকি আইনকানুনেও ইহুদিদের দেখানো হয়েছে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে। জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ওপর এই ঔপনিবেশিক শাসন জেঁকে বসেছে। ফলে খুব দ্রুতই ধর্মান্ধ ও চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়। আর তাদের জায়গা করে দেন ইসরায়েলেরই সুযোগসন্ধানী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। জোট সরকার গঠন করে ইসরায়েল তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস করতে শুরু করে এবং ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি এই দুই জাতির পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের যে সম্ভাবনা, তা পুরোপুরি নাকচ করে দেয়।
আপসের সব সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়ে তারা এবার পুরো ফিলিস্তিন দখলের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জমি চুরি করে ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য—ফিলিস্তিনিদের জমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তারা পশ্চিম তীর নামের বিশ্বের বৃহত্তম খোলা জেলখানায় এই অবৈধ বসতি স্থাপন করে চলেছে। ইসরায়েলিরা এখন এতটাই বেপরোয়া যে স্বাধীন–সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সঙ্গে পশ্চিম তীরকে যুক্ত করার যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি তারা অতীতে দিয়ে আসছিল, সেই প্রতিশ্রুতিটুকুও আর দিচ্ছে না।
গাজার এই যুদ্ধ হয়তো শেষের শুরু। তবে তা ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়। ঠিক যেমন করে দক্ষিণ আফ্রিকার রক্তপিপাসু শ্রেষ্ঠত্ববাদী সরকার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, একইভাবে সমাপ্তি ঘটবে ইসরায়েলের। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
এরপর এল ৭ অক্টোবর। এদিন একটি কঠোর বার্তা দিল যে উপনিবেশ বিস্তারের চেষ্টা কার্যকর আর টেকসই হতে পারে না। দিনটি আরও বার্তা দিল যে ২০ লাখ মানুষকে অবরুদ্ধ করে তারা চাবি ছুড়ে ফেলে দিতে পারে না। ফিলিস্তিনিরা বলার চেষ্টা করছে যে সংঘাতের মূল কারণ এবার খুঁজে বের করতেই হবে। খুঁজে বের করতে হবে—কেন তাদের জমিজিরাত কেড়ে নেওয়া হলো, কেন দখল করা হলো, কেনইবা অবরুদ্ধ করা হলো।
কিন্তু নেতানিয়াহুর সরকার স্বভাবজাত কারণেই এই মর্মান্তিক ঘটনাকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেল। আর ফিলিস্তিনিদের অমানুষ প্রমাণে উঠেপড়ে লাগল। কারণ, ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়—এই প্রচার তাকে জাতিগত নিধনের পথে এগোতে সাহায্য করবে। তিনি এই যুদ্ধকে শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে অভিহিত করলেন। যার অর্থ দাঁড়াল—এই যুদ্ধ শুধু হামাসের বিরুদ্ধে নয়; বরং গাজাবাসীর বিরুদ্ধে। প্রেসিডেন্টসহ ইসরায়েলি নেতাদের একজনের পর একজন, ভয়ংকর এই হামলার জন্য সব ফিলিস্তিনিকে অভিযুক্ত করলেন। তাঁরা দাবি করলেন, গাজায় কোনো নিরপরাধ মানুষ নেই।
যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েলিরা তাই প্রতিহিংসাপরায়ণ ও চরম গোষ্ঠীবাদী আচরণ শুরু করে। মৌলিক মানবাধিকার, মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। ইসরায়েলের এই উপনিবেশবাদী যুদ্ধের শিকার হয় হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, আবাসিক ভবন। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রের আশকারায় তারা শিশু, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধদের নির্বিচার খুন করে চলে।
কিন্তু বিদেশি গোষ্ঠীবাদীদের এই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, আদিবাসী এই জনগোষ্ঠী অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় রক্তপিপাসু অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। ইসরায়েল তাদের এই সহিংস বর্ণবাদী আচরণকে ন্যায্যতা দিতে যতই ধর্মের দোহাই দিক না কেন, তা আর কাজে আসবে না। স্রষ্টা নিরপরাধ শিশুদের হত্যার অনুমোদন দেয় না। ইসরায়েলের মার্কিন ও পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদেরও হত্যাকে সমর্থন করা উচিত হবে না।
যেহেতু পশ্চিমে জনমত ক্রমে ইসরায়েলের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে, তাই পশ্চিমের নিষ্ঠুর নেতারাও তাঁদের গতিপথ পরিবর্তন করবেন। তাঁদের নৈতিক অবস্থানের হয়তো পরিবর্তন হবে না; কিন্তু দেশগুলো বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ সুরক্ষার চেষ্টা করবে। গাজায় শিশুহত্যা বন্ধের দাবিতে ফ্রান্সের যে অবস্থান, তা-ই প্রমাণ করে পশ্চিমাদের অবস্থান বদলাচ্ছে।
এই কুৎসিত যুদ্ধের পর ইসরায়েলের হাতে আর কোনো ভালো বিকল্প নেই। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে উদ্ধার পেতে এটিই দেশটির জন্য শেষ সুযোগ। তাদের উচিত হবে যুদ্ধ বন্ধ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলছেন, তা মেনে নেওয়া। যদিও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবস্থা এখন অবাস্তব। তারা অন্তত গাজার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে রেডলাইন নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা মেনে চলুক। যুক্তরাষ্ট্র গাজা পুনর্দখল বা জাতিগত নিধনের বিপক্ষে এবং গাজার যে আয়তন তা অপরিবর্তিত রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। নেতানিয়াহু এবং তাঁর ধর্মান্ধ জোট বহুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে গ্রাহ্য করছে না। তারা আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে উপেক্ষা করেছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে দুই দেশেরই।
গাজায় যুদ্ধ শুরুর বহুদিন আগেই ইসরায়েলের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক আরি সাভিত বলেছিলেন, ইসরায়েলের পতন ঘটবে এ কথা সবার জানা। কারণ, তারা ধ্বংসাত্মক পথে চলছে। আর গত সপ্তাহে গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের সাবেক প্রধান আমি আয়ালান সরকারকে সতর্ক করে বলেন, যুদ্ধ এবং বসতি স্থাপন ইসরায়েলকে শেষ করে দেবে। দুজনই এ নিয়ে বই লিখেছেন।
প্রাচীন আমলের ক্রুসেডার থেকে শুরু করে বিশ্বের যেকোনো সহিংস অনুপ্রবেশকারীর পতন ঘটেছে। এ যুগের একমাত্র ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হলো ইসরায়েল। ইসরায়েলের পতনও অবশ্যম্ভাবী। ফিলিস্তিনি, আরব ও ইসরায়েলিদের যত রক্তই ঝরুক না কেন, এই শক্তি টিকবে না।
গাজার এই যুদ্ধ হয়তো শেষের শুরু। তবে তা ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়। ঠিক যেমন করে দক্ষিণ আফ্রিকার রক্তপিপাসু শ্রেষ্ঠত্ববাদী সরকার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, একইভাবে সমাপ্তি ঘটবে ইসরায়েলের। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
মারওয়ান বিশারা আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নিবদ্ধটি আলজাজিরায় প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শেখ সাবিহা আলম