একটা সময় দেশের বাইরে এলে যা কিছু দেখতাম, মুগ্ধ হতাম। আফসোস করতাম, দেশে এমন সুবিধা যদি থাকত! আজকাল খুব একটা আফসোস করতে হয় না। কারণ, বিদেশের প্রায় সব সুবিধাই এখন আমরা দেশে বসে উপভোগ করি। তারপরও একটা আফসোস খুব হয়।
যখন দেশের বাইরে পেমেন্ট করতে যাই, মনটা খারাপ হয়ে যায়। যত বড় অঙ্ক হোক, যেখানে খুশি হোক; ওসব দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট করা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি এখনো এই ডিজিটাল পেমেন্টকে এতটা সর্বজনীন করে তুলতে পেরেছি? পারিনি। আর সেটা খুব দ্রুত করতে না পারলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ক্যাশলেস সমাজের দিকে ছুটতে পারব না।
এবার ঈদুল আজহার আগের তিন-চার দিনে শুধু নগদ মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে গড়ে দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হতে দেখেছি। গরুর টাকার লেনদেনও হয়েছে ঢের। বাজারে আরও কয়েকটি বড় মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আছে।
সবার মিলিয়ে এই দিনগুলোতে চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হওয়ার কথা। অঙ্কটা একটু কমবেশিও হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করেন তো একবার; দেশে মোটা কোরবানির ঈদের কেনাকাটার বাজার তো এত ছোট না।
ধারণা করা হয় যে এই ঈদে আমাদের শুধু পশু বিকিকিনির বাজারই কয়েক শ কোটি টাকার ওপরে। বাজারটা তো অবশ্যই ক্যাশলেস হতে পারে। সেটা হওয়া খুবই জরুরি। কারণ, পশু কেনাবেচার হাঁটে এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো মোটা অঙ্কের টাকা পরিবহন।
ক্রেতারা এতে ঝুঁকিতে থাকেন এবং বিক্রেতারাও এই টাকা নিয়ে যাঁর যাঁর এলাকায় ফিরতে বিপদে পড়েন। প্রতিবছরই আমরা গরু বেচাকেনার টাকা ছিনতাই–রাহাজানির খবর দেখি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট উন্নত হলেও ব্যাপারটা একেবারে বন্ধ করার জন্য চাই ক্যাশলেস লেনদেন।
শুনলে অবাক হতে পারেন যে কেউ যে নাটোরের সিংড়াতে একটি ক্যাশলেস পশু বেচাকেনার হাটের আয়োজন করা হয়েছিল এ বছর। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের প্রচেষ্টায় হয়েছিল এই আয়োজন।
গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, একমাত্র মোবাইল আর্থিক সেবা হিসেবে এই প্রান্তিক হাটে ক্যাশলেস লেনদেনের মাধ্যম ছিল নগদ। আমরা দেখেছি, হাটটির আয়োজন অত্যন্ত সফল হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের আয়োজন আমাদের এই অভিজ্ঞতাও দিচ্ছে যে মোবাইল ব্যাংকিং আসলে এই হাটের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা রাখে না।
সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সেখানে গরু বা খাসির দামও এখন অনেক বেশি। একটি মাঝারি মাপের গরুর দাম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রচলিত মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব নয়। আবার ঈদের ছুটির সময় বা ব্যাংকিং সময়ের পর ব্যাংকেও এত অর্থ লেনদেন করা যায় না। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের উৎসবভিত্তিক বড় কেনাকাটাকে ডিজিটাল করার একমাত্র উপায় হতে পারে ডিজিটাল ব্যাংক।
আসলে এত ছোট পরিসরে ডিজিটাল লেনদেনের উপকারিতা ভাবা ঠিক নয়। ডিজিটাল লেনদেন তথা ডিজিটাল ব্যাংকিং নিশ্চিত করতে পারলে সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার হবে, সেটা হলো আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে শতভাগের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারব। এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রথাগত ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করেন না। প্রত্যন্ত এলাকায় কোটি কোটি টাকা হাতবদল হয় ক্যাশ টাকা হিসেবে।
এসব শিক্ষাকে ধারণ করেই আমরা গড়ে তুলছি আমাদের স্বপ্নের ডিজিটাল ব্যাংক। খুব দ্রুত কাজ এগোচ্ছে। আমার বিশ্বাস, ডিজিটাল ব্যাংকের সময়ে যত বড় উৎসবভিত্তিক কেনাকাটা হোক, তা পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন করা সম্ভব হবে। তখন আর লাখ টাকা পকেটে নিয়ে বাজারে যেতে হবে না। মোবাইলের একটি অ্যাপ দিয়েই এ ধরনের বড় কেনাকাটা করা সম্ভব হবে। আর সেটাই পারে আমাদের ক্যাশলেস সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
সরকার লক্ষ্য ঠিক করেছে, ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে শতভাগ ক্যাশলেস সমাজে পরিণত করা হবে। সেটার জন্য এই স্মার্ট বাংলাদেশে অবশ্যই শতভাগ ডিজিটাল লেনদেন নিশ্চিত করতে হবে। কেবল পশুর হাট বা উৎসবের কেনাকাটা নিরাপদ করাই ডিজিটাল লেনদেন বা ক্যাশলেস সমাজ গড়ার কারণ নয়।
আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে চাইলে এটি খুব জরুরি ব্যাপার। সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা উপভোগ করার জন্য হলেও ক্যাশলেস সমাজ প্রয়োজন। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য।
ছোট্ট একটি খাতের কথা বলি, এই যে টাকা ছাপানোর খরচ, সেটাও কিন্তু কল্পনাতীত। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ম্যাকেঞ্জির তৈরি করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কেবল টাকা ছাপানো ও এর ব্যবস্থাপনার জন্য বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এখন সেই অঙ্কটা ফুলেফেঁপে নিশ্চয়ই আরও বড় হয়েছে। ফলে আপনি ডিজিটাল লেনদেন নিশ্চিত করলে অন্তত এই টাকাগুলোর সাশ্রয় হবে। কে না জানে, মুহূর্তে টাকা লেনদেন করতে পারার সুবিধা চালু হলে ‘মানি মাল্টিপ্লায়া’ ইফেক্টের মাধ্যমে টাকার ব্যবহার অনেক বেশি হবে। ফলে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আসলে এত ছোট পরিসরে ডিজিটাল লেনদেনের উপকারিতা ভাবা ঠিক নয়। ডিজিটাল লেনদেন তথা ডিজিটাল ব্যাংকিং নিশ্চিত করতে পারলে সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার হবে, সেটা হলো আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে শতভাগের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারব। এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রথাগত ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করেন না। প্রত্যন্ত এলাকায় কোটি কোটি টাকা হাতবদল হয় ক্যাশ টাকা হিসেবে।
নানা কারণেই ব্যাংক বা এমএফএস সেখানে পৌঁছাতে পারছে না এবং এই প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। ডিজিটাল ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঘরে পৌঁছে যাওয়া। আর তা হলে এই হিসাবের বাইরে থাকা শত শত কোটি টাকা রাষ্ট্রের হিসাবে চলে আসবে। রাতারাতি বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক গুণ বড় হয়ে যাবে।
আমরা এখন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছি। সেটা সম্ভব করতে হলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর লেনদেনকে কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। কেবল ডিজিটাল ব্যাংকই কাজটি নিশ্চিত করতে পারে। সব জায়গায় ডিজিটালি পেমেন্ট করতে না পারার ওই আফসোস নিশ্চয়ই তখন আর আমার থাকবে না। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য এটি হবে অনন্য ধাপে পদার্পণ।
এত স্বপ্ন আর সম্ভাবনা সামনে রেখে যারা নতুন সেবা তৈরি করবে, সরকারের দিক থেকে তাদের জন্য কিছুটা হলেও নীতি–সহায়তার প্রয়োজন হবে। সেগুলো নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনা করবেন বলে আশা রাখছি।
তানভীর এ মিশুক প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি।