মতামত

সমস্যা সৃষ্টি করে সুবিধা গ্রহণ: এক অদ্ভুত সমাধানসূত্র

আমাদের জাতীয় জীবনে সমস্যার কোনো শেষ নেই। জাতীয়-স্থানীয় বড়–ছোট নানা সমস্যাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায়ই সমস্যার সৃষ্টির করা হয় কিছু লাভ ও লোভের কারণে। লাভ ও লোভ দিন দিন বাড়ে। বাড়ে সমস্যার আকার ও আকৃতি। বড় হতে হতে সেসব সমস্যা স্থানীয় থেকে জাতীয়, জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। সমস্যার যত ভোগান্তি, সব নিরীহ মানুষের; আর তা সৃষ্টি ও লালন করে কিছু মানুষ। তাদের জন্য তৈরি হয় ক্ষমতা ও বিত্ত আহরণের অবারিত সুযোগ। ঘুরেফিরে সমাধানের ব্যবস্থাও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। মূল সমস্যা জিইয়ে রেখে সমাধানের সূত্র খোঁজা হয়। নিচে কয়েকটি তুচ্ছ স্থানীয় ও বড় জাতীয় ঘটনা দেখা যেতে পারে।

ঘটনা-১: মৃদু নিষেধ সত্ত্বেও পথ কমানো এবং ভিড় এড়াতে চালক বড় সড়ক থেকে ছোট সড়ক দিয়ে ঘুরে যেতে চাইলেন। ঢুকতেই ঘটে গেল বিপত্তি। সেই ছোট সড়কে একটি মিনিট্রাক মুদিদোকানে মালামাল নামাচ্ছে। এতে বিপরীতমুখী দুই গাড়ির কারণে পুরো সড়ক বন্ধ হয়ে গেল। অসহায়ের মতো গাড়িতে বসে আছি। চারদিক থেকে হইচই–চেঁচামেচি। সবার সচিৎকার সমাধান—সামনে যাও, একটু পেছনে, তারপর সামনে, ডানে কাট, বাঁয়ে কাট। রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, তরকারি বিক্রেতা—সবাই সমাধান দিচ্ছে। তাদের কথায় আমার চালক এক ইঞ্চি এগোতেই বাঁয়ের তরকারির দোকানি লাঠি দেখায়—থাম, খামোশ। ডানে ট্রাকে চালক নেই। খুঁজে আনা হলো। ট্রাকে এক ইঞ্চি টান পড়তেই আমার চালকের চিৎকার—লেগে গেল, লেগে গেল। এভাবে আধা ঘণ্টা কাটল। মাল খালাস হলো। ট্রাক পিছিয়ে গেল। আমরা মুক্তি পেলাম।

বর্তমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংকট, তার কারণ ও লালনের সূত্র একই প্রকৃতির। সমস্যার মূলে কেউ যাবে না। ন্যায্যতা নয়, বল প্রয়োগেই একতরফা চাপানো সমাধানে গোষ্ঠীস্বার্থ ও সুবিধা রক্ষা হয়

সরু সড়কে বিপরীতমুখী দুটি গাড়ির জট ও দুপাশের পথচারী রিকশা, ঠেলা—সবার যাতায়াতে বাধার এ–জাতীয় সমস্যা এবং তা নিয়ে হইচই, হাতাহাতি এ জায়গার নিত্যঘটনা। সমস্যার গোড়াটি কোথায়? সরকারিভাবে এটি ৩০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা। দুটি গাড়ি অনায়াসে যাওয়ার কথা। সিটি করপোরেশন প্রতিবছর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। এক পাশে বাঁধানো ফুটপাতও আছে। কিন্তু ৩০ ফুট রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতসহ ৭ + ৭ = ১৪ ফুট বেআইনিভাবে দখল করে (আগে অস্থায়ী ছিল) এখন স্থায়ী দোকান। চলাচলের জন্য অবশিষ্ট আছে ১৫ থেকে ১৬ ফুট। দুই পাশে উঁচু দোকান হওয়ায় মাঝের রাস্তায় পানি জমে থাকে। এসব বেআইনি দোকান–স্থাপনা থেকে শক্তিশালী একটি চক্র পকেট ভারী করে। ব্যবস্থাটি মোটামুটি পাকাপোক্ত। তাহলে সমস্যাটি কোথায়, ভোগান্তিটা কার, কী সমাধান? এ বেআইনি বাজারের আবার একটি আইনি কমিটি আছে। তারা মারামারি থামায়। লাঠি মারে। টাকা ওঠায়, যার ভাগ তার কাছে যায়। বছরের পর বছর এ ব্যবসা চলে। কয়েক মিটারের মধ্যে পুলিশের একটি অফিসও আছে। স্থান মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প–সংলগ্ন বাবর রোড।

ঘটনা-২: মসজিদে দানের কাঁঠালের নিলাম নিয়ে সংঘর্ষ। ৪ জন নিহত ও ২০ জন আহত। ঘটনার দুই পক্ষ—মালদার মিয়া ও দ্বীন ইসলাম। ৩০ বছর আগে মালদার মিয়ার বাবা খুন হওয়ার জেরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ প্রায় সময়ই প্রাণঘাতী সংঘর্ষে রূপ নেয়। দুর্ঘটনার শুরু মসজিদে। মসজিদে দান করা একটি কাঁঠাল থেকে কীভাবে চার–চারটি মৃত্যুর ঘটনার বিস্তার হতে পারে! এ দেশের সমাজ–সভ্যতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? সুনামগঞ্জের ওই এলাকায় থানা-পুলিশ, আদালত, প্রশাসন, সমাজনেতা, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় সরকার—সবাই আছে। এরপরও এত বছর পুরোনো বিরোধ কীভাবে জিইয়ে থাকে।

ঘটনা-৩: ডিবি সূত্রে প্রথম আলোর খবর (১২ জুলাই ২০২৩), পুলিশের সোর্স থেকে শহীদ মাঝি ডাকাতের সরদার। পুলিশ কীভাবে অপরাধীদের সোর্স বানায় এবং তাদের মাধ্যমে নিজেরাও অপরাধে জড়িত হয়, তার অনেক কাহিনি বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় দেখা গেছে। সোর্সকে দেওয়ার জন্য সরকার থেকে নেওয়া অর্থ আত্মসাৎ এবং সোর্স নানা অপরাধ করে নিজের আয় নিজে করে নেয় এমন অভিযোগও কম নয়। এভাবে কি অপরাধী থেকে ‘সোর্স’ নেওয়া হয়, নাকি সোর্স থেকে অপরাধী জন্ম হয়, ভেবে দেখার বিষয়।

ঘটনা-৪: ’৯৪ সালে বিএনপি আমলে মাগুরার নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম দেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রউফ কিছু না করেই ঢাকা ফিরে আসেন। শুরু হয় নির্বাচন বাতিলের তুমুল আন্দোলন থেকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠার লাগাতার আন্দোলন। প্রায় ১৭০ দিনের হরতাল, রাজপথে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। অবশেষে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬) ও দাবি মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে সংবিধান সংশোধন, সংসদ বাতিল ও ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নতুন নির্বাচন। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন।

ঘটনা-৫: আওয়ামী শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভ ও সরকার গঠন করল। এরপর সে সরকার বিদায়ের প্রাক্কালে বিচারপতির চাকরিকালের মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি। নির্বাচন কমিশন ও ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন ব্যবস্থা ও দুই বছর পর সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই–তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করে ফের ক্ষমতা গ্রহণ। এরপর সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করা ও সংসদ বহাল রেখে নতুন সংসদ নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন।

এ পাঁচটি ঘটনার তিনটি স্থানীয় ও দুটি জাতীয়। একটি জায়গায় অদ্ভুত মিল। সমস্যাগুলোর সৃষ্টি কোনো নির্দোষ কারণে নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বিশেষ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সমস্যাগুলোর উৎপত্তি। সহজ সমাধানের পথ জানা থাকা সত্ত্বেও সে পথে না গিয়ে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের নানা কূটকৌশল প্রয়োগই এখানে দেখা যায়। এভাবে স্থানীয় সমস্যা থেকে বৃহত্তর জাতীয় সমস্যা, মানুষের জানমাল সামগ্রিক জাতীয় চরিত্র নষ্ট করছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি প্রকাশ হয়ে পড়ছে। সমস্যা থেকেই সুবিধা গ্রহণ—এ অদ্ভুত সমাধানসূত্রই এখানে কাজ করছে। বর্তমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংকট, তার কারণ ও লালনের সূত্র একই প্রকৃতির। সমস্যার মূলে কেউ যাবে না। ন্যায্যতা নয়, বলপ্রয়োগেই একতরফা চাপানো সমাধানে গোষ্ঠীস্বার্থ ও সুবিধা রক্ষা হয়। 

ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ