গত ২৬ মার্চ ২০২২, স্বাধীনতা দিবসে মাত্র একজন নারী ও একজন পুরুষ প্রবীণ নিয়ে মনোয়ারা ইসলাম তাজুল ইসলাম ট্রাস্ট পরিচালিত ‘শৈলান প্রবীণ নিবাস’-এর যাত্রা শুরু হয়। সে হিসেবে দুই বছর পেরিয়ে তিন বছরে পদার্পণ করেছে শৈলান প্রবীণ নিবাস।
বর্তমানে আমাদের প্রবীণ নিবাসে বাসিন্দার সংখ্যা ৪০। আমরা তাঁদের বিনা মূল্যে উন্নতমানের আবাসন, খাবার, পোশাক, প্রসাধনসামগ্রী, ওষুধ ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহায়তায় মৌলিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করছি। নিবাসটির ধারণক্ষমতা ৮০ জন। সে হিসাবে আমাদের গ্লাস, যে যেভাবে দেখেন, অর্ধেকটা খালি অথবা অর্ধেকটা পূর্ণ। সে যা-ই হোক, এই দুবছরে আমরা দুস্থ প্রবীণদের দেখভালের বিষয়টি সম্পর্কে বেশ কিছু জেনেছি ও শিখেছি। সেসব নিয়ে আজকের এই লেখা।
আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনটি ছিল অপ্রত্যাশিত। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন প্রবীণকে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমরা আবার মেলাতে সক্ষম হয়েছি। বিষয়টি খুলে বলা দরকার। এসব প্রবীণ তাঁদের পরিবারের অবহেলা পেয়ে শৈলান প্রবীণ নিবাসে ঠাঁই নেন। বা ভরণপোষণে অক্ষম সন্তান বা আত্মীয়স্বজন তাঁদের রেখে যান। প্রবীণেরা এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেন। তাঁদের পরিবার হয়তো আশা করেছিল যে প্রবীণেরা বাড়ি ফেরার জন্য কাকুতিমিনতি করবেন। কিন্তু দেখা গেল তাঁরা এখানে বৃহত্তর পরিসরে নতুন পরিবারে আনন্দেই আছেন।
একদিকে পরিবার বুঝতে পারে যে প্রবীণেরা একদম অসহায় নন, তাঁদের দেখভাল করার জন্যও প্রতিষ্ঠান আছে। আবার বাবা, মা বাসা থেকে চলে যাওয়ায় সন্তানেরা সামাজিক চাপেরও সম্মুখীন হন। এই দুই কারণে কয়েক মাস অবস্থানের পর পরিবার তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়। আমরা তাতে সানন্দে সম্মতি জানাই। কেননা আমাদের স্লোগান হচ্ছে, ‘প্রবীণদের জন্য পরিবারই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল। কিন্তু যাঁদের দেখাশোনার কেউ নেই; পরিবার ভরণপোষণে অক্ষম, সেসব অসহায় দরিদ্র ও অবহেলিত প্রবীণদের জন্যই শৈলান প্রবীণ নিবাস।’
এভাবে ফিরে যাওয়া একজন প্রবীণ সেদিন শৈলান প্রবীণ নিবাসে এসেছিলেন তাঁর নতুন বন্ধুদের জন্য বেশ কিছু বিস্কুট নিয়ে। বাসায় ফিরে কেমন লাগছে জানতে চাইলে বললেন, ‘খুব ভালো।’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আমি ছেলেমেয়েদের বলে দিয়েছি তোমাদের অসুবিধা হলে আমি আবার শৈলান প্রবীণ নিবাসে ফিরে যাব।’ এ কথা ভেবে আনন্দ হলো যে প্রবীণেরা শৈলান প্রবীণ নিবাসকে তাঁদের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ভাবছেন।
অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে দারিদ্র্য সম্পর্কে যা জেনেছিলাম, তার ভিত্তিতে ধারণা করেছিলাম যে দরিদ্র ও অবহেলিত, মানে যাঁদের জমিজিরেত, পড়াশোনা বা টাকাকড়ি নেই। শৈলান প্রবীণ নিবাসে এসে জেনেছি, যে-কেউ দরিদ্র ও অবহেলিত হতে পারেন।
আমাদের এখানে অবস্থানরত প্রবীণদের মধ্যে কয়েকজন আছেন, যাঁদের একসময় বড় ব্যবসা ছিল, উচ্চ পদের চাকরি ছিল, এমনকি তাঁরা উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু ভাগ্যের ফের তাঁদের প্রবীণ নিবাসে ঠাঁই নিতে বাধ্য করেছে। এসব জেনে নিজেদের ভাগ্যবান মনে হয়, অবনমিত বোধ করি।
শৈলান প্রবীণ নিবাসের একটি সীমাবদ্ধতা হলো, এখানে প্রবীণদের নিজের কাজ, যেমন বিছানা করা, কাপড় ধোয়া, বাথরুমে যাওয়া, খাবার খাওয়া নিজেদের করতে হয়। অর্থাৎ নিবাসটি সচল প্রবীণদের জন্য। অথচ দুস্থ প্রবীণদের অনেকেই এসব নৈমিত্তিক কাজ করতে অসমর্থ। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সহায়তা প্রয়োজন।
শৈলান প্রবীণ নিবাসে এ ধরনের চলাচলে অক্ষম ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের অবকাঠামো বা জনবল কোনোটাই নেই। আমাদের নিবাসের অবকাঠামো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের মতো, প্রক্ষালনব্যবস্থা শোবার ঘরের বাইরে।
এ ছাড়া এ ধরনের প্রবীণদের দেখভাল করার জন্য আয়া, নার্স ও চিকিৎসক প্রয়োজন, যা আমাদের নেই। বাণিজ্যিক বা দাতব্য ভিত্তিতে ভবিষ্যতে যাঁরা প্রবীণ নিবাস প্রতিষ্ঠা করবেন, তাঁরা বিষয়টি মাথায় রাখতে পারেন।
চলাচলে অক্ষম প্রবীণদের জন্য প্রয়োজন নার্সিং হোম। এখন প্রশ্ন হলো, শৈলান প্রবীণ নিবাসে বর্তমানে যাঁরা অবস্থান করছেন, তাঁদের কেউ চলাচল ক্ষমতা হারালে কী হবে। আমরা তাঁদের বের করে দিতে পারি না।
এই দায়িত্ববোধ থেকে আমরা বর্তমান প্রবীণ নিবাসসংলগ্ন ২২ শতাংশ জমি কিনে সেখানে ১০ শয্যার নার্সিং হোম গড়ে তুলছি। যা এ বছরের মধ্যেই চালু হবে বলে আশা করছি। ঢাকার অদূরে ধামরাইতেও চিকিৎসক পাওয়া অসম্ভব। বিষয়টি প্রতিনিয়ত আমাদের ভাবাচ্ছে। সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য বিভাগ আমাদের মতো সরকারের সঙ্গে নিবন্ধিত প্রবীণ নিবাসে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ প্রদানের বিষয়ে ভাবতে পারেন।
শৈলান প্রবীণ নিবাসের ট্রাস্টিদের বেশির ভাগই বয়োজ্যেষ্ঠ। তাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ব্যক্তিদের ট্রাস্টি হতে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা এমন ব্যক্তিকে খুঁজছি, যিনি নিবাসের জন্য তাঁর নিজস্ব সম্পদ ও সময় ব্যয় করবেন; প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার, এর সুনাম রক্ষা করবেন এবং এ ক্ষেত্রে সব ধরনের স্বার্থের সংঘাত পরিহার করে সততার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় সহায়তা করবেন।
শৈলান প্রবীণ নিবাসের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিষ্ঠানটিকে টেকসই করা। এ জন্য ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে, সরকারের রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন গ্রহণ করা হয়েছে ও এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে টিন ও আয়কর
অব্যাহতি নেওয়া হয়েছে। নামজাদা অডিট ফার্ম হোদা ভাসি অ্যান্ড চৌধুরী বিনা মূল্যে আমাদের হিসাব নিরীক্ষা করছে, নিয়মিত আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা একটি গোছানো প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছি।
একজন দক্ষ সুপারিনটেনডেন্ট, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও রাঁধুনিদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। আমাদের বর্তমান বাসিন্দাদের অনেকেরই শৈলান প্রবীণ নিবাসে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, যা আমাদের প্রতিষ্ঠানের সেবার উন্নতমানের কারণেই সম্ভব হয়েছে।
শৈলান প্রবীণ নিবাসের ট্রাস্টিদের বেশির ভাগই বয়োজ্যেষ্ঠ। তাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ব্যক্তিদের ট্রাস্টি হতে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা এমন ব্যক্তিকে খুঁজছি, যিনি নিবাসের জন্য তাঁর নিজস্ব সম্পদ ও সময় ব্যয় করবেন; প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার, এর সুনাম রক্ষা করবেন এবং এ ক্ষেত্রে সব ধরনের স্বার্থের সংঘাত পরিহার করে সততার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় সহায়তা করবেন।
বর্তমান ট্রাস্টিদের মত, তাঁর কাজের জন্য তিনি কোনো সম্মানী, ভাতা পাবেন না; যাতায়াতের মতো খরচ পুনর্ভরণ এবং নিজের আত্মীয়স্বজনদের নিবাসের কাজে বা এর সঙ্গে কোনো
ব্যবসায় নিয়োজিত করবেন না। আমরা জানি, আমাদের দেশে যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, সেখানে এ ধরনের ট্রাস্টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। অথচ শৈলান প্রবীণ নিবাসের মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এ ধরনের সম্মানীয় ব্যক্তি একান্ত আবশ্যক।
সর্বশেষ জনসংখ্যা ও গৃহায়ণ শুমারি ২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ বা প্রায় দেড় কোটি মানুষের বয়স ষাট বা তাঁর চেয়ে বেশি, যা বাড়ছে। দেড় কোটি প্রবীণের মধ্যে ২০ শতাংশ, প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এ বিপুলসংখ্যক দুস্থ প্রবীণের ১০ শতাংশও যদি আশ্রয়হীন হয়ে থাকে, তাহলে প্রায় ৩ লাখ মানুষের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতি উপজেলায় প্রবীণ নিবাস স্থাপন করতে হবে।
বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা আশা করছি অচিরেই শৈলান প্রবীণ নিবাসের পূর্ণ ধারণক্ষমতা ব্যবহৃত হবে। অন্য মানসম্পন্ন নিবাসগুলোরও একই অবস্থা। তাই এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের চলার পথে আমরা দাতা, শুভানুধ্যায়ী, স্বেচ্ছাসেবক, ট্রাস্টি, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ও নিবাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অকুণ্ঠ সহায়তা পেয়েছি। আজকের এই বর্ষপূর্তিতে তাঁদের সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা শৈলান প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি প্রতিষ্ঠানটিকে আপন করে নেওয়ার জন্য।
দিলরুবা কবির ও মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান শৈলান প্রবীণ নিবাসের সভাপতি ও উপদেষ্টা। ই–মেইল: shailanprobeennibash@gmail.com