আগামীকাল ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পূর্ণ হবে। চুক্তির মৌলিক কয়েকটি বিষয় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরকারী এক পক্ষ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অপর ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।
কিন্তু স্বাক্ষরকারী অপর পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মতে, ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলোর ১৮টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে আর ২৯টি সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। ফলে প্রশ্ন জাগে—চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন আদৌ হবে কি? হলে সেটা আরও কত যুগ লাগবে?
চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল একনাগাড়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের মধ্যে চরম উদাসীনতাই দৃশ্যমান হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অনেক অর্জনের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য চুক্তি’। এ চুক্তির জন্য তৎকালীন তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম বয়ে আনলেও পরবর্তীকালে চুক্তিটির প্রতি আওয়ামী সরকার তার প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গেছে।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ (২০১৮) নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে কেবল চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করার বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা এ–সম্পর্কিত কথা উল্লেখই করা হয়নি। ইশতেহারের ৩.২৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে চুক্তির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছে। ক্ষমতায়নের এ ধারা চুক্তির শর্তানুযায়ী অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আরেকটি অন্যতম শর্ত হলো পাহাড়ে বিরাজমান ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা। চুক্তি মোতাবেক ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও এ কমিশনের বিধিমালা আজ অবধি প্রণীত না হওয়ায় এটি এখনো পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। ইতিমধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কমিশনের কাছে ২২ হাজারের অধিক আবেদন জমা পড়ে আছে। কমিশন এযাবৎ কেবল সভা আহ্বান করে যাচ্ছে, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।
বাহাত্তর সালে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়ে যে ভুল করেছিল, চার দশক লেগেছে রাষ্ট্রের সেই মাশুল শোধরাতে। তেমনি চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরেও চুক্তির মৌলিক ধারা বাস্তবায়িত না হওয়ার মাশুল রাষ্ট্রকে হয়তো একদিন সেভাবে গুনতে হবে। তত দিনে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় হয়তো বহু জল গড়িয়ে যাবে!
এর মধ্যে এ কমিশনের সর্বশেষ সভা গত ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলার বাঙালিদের সদ্য গঠিত সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’ এর আহূত ৩২ ঘণ্টার সড়ক অবরোধের জন্য সভাটি বাতিল করা হয়। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় জনবল, অবকাঠামোগত সরঞ্জাম ও তহবিলের সংকট ও বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে কমিশনের কার্যক্রম বারবার ব্যাহত হচ্ছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যক্রম একপ্রকার স্থবিরই বলা চলে।
গত ২৫ বছরের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চুক্তির পরে পাহাড়ে শান্তির চেয়ে অশান্তির মাত্রাটাই বেশি বইছে। চুক্তির পরে শুধু আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়েনি, এ দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাগুলোতে ফাটল ধরিয়ে দিচ্ছে।
এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো বান্দরবানের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আবির্ভাব (সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ মে ২০২২)। ২০০৮ সালে ‘কুকি-চীন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ নামে বান্দরবানের রুমায় প্রথম গঠন করা হয়। এ সংগঠনের সঙ্গে বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কেএনএফ তাদের শাসিত কুকি-চীন ‘স্টেট’ দাবি করলেও তারা সরকারের কাছে কোনো রাজনৈতিক দাবি জানায়নি।
উল্লেখ্য, এ বছরের ২২ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার একটি ত্রিপুরা গ্রামে হামলা করে এই গ্রুপ তিন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এতে দুই শিশু গুলিতে আহতও হয় (সূত্র: ডেইলি স্টার)। এ ছাড়া কেএনএফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুবই সক্রিয়। তারা তাদের নিজস্ব ফেসবুকের পেজে তাদের সামরিক ট্রেনিংয়ের ছবিসহ সদস্যদের ছবি পোস্ট দেয়। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই কেএনএফের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কাজেই এসব ঘটনা থেকে এটাই পরিষ্কার যে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও বিভাজন তৈরির জন্য বিশেষ মহল এখনো তৎপর।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি থেকে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা যেন অঘোষিত চলমান একটি প্রক্রিয়া। চুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুয়ার সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। সেখানে পর্যটনশিল্পও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
এ সুযোগে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনী, ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পার্বত্য এলাকার হাজার হাজার একর জমি লিজ নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে সেখানে বিলাসবহুল রিসোর্ট গড়ে তুলছে। আমরা বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ কিংবা লামা উপজেলার দুর্গম ম্রো পাড়ায় রাবার কোম্পানির লোকদের দ্বারা জুমের বাগান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে পারি। লামায় আগুনে প্রায় এক শ একর জুমের ধানসহ বিভিন্ন ফলদ বাগান পুড়ে যায়।
অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে, যে সড়ক নির্মাণের ফলে বহু পাহাড়ি গ্রাম উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে রয়েছে। এ এলাকার বসতিরা মূলত ষাটের দশকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে এসব সীমান্ত এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন। এ সড়ক নির্মাণের ফলে শুধু পাহাড়ি গ্রামগুলো উচ্ছেদ হবে তা নয়, পাহাড় ও অসংখ্য বন, গাছ কাটা পড়বে। এতে পাহাড়িদের জীবন–জীবিকার পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যও হুমকির সম্মুখীন হবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবিধানের ৫০ বছর পালিত হয়েছে এবং ‘৪ নভেম্বর’ রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবিধান দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সংবিধানের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় এম এন লারমা বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিসত্তাসমূহের সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন। কিন্তু লারমার দাবিকে উপেক্ষা করে সংবিধান পাস করা হয়েছিল।
অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সেই বোধ তৈরি হতে সময় লেগেছে আরও চার দশক! ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এখন ৫০টি জাতিসত্তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি রয়েছে। এই একটি বিষয় থেকেই বোঝা যায় এম এন লারমার চিন্তার গভীরতা কতটা গভীর ও দূরদর্শী ছিল।
বাহাত্তর সালে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর খাটিয়ে যে ভুল করেছিল, চার দশক লেগেছে রাষ্ট্রের সেই মাশুল শোধরাতে। তেমনি চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরেও চুক্তির মৌলিক ধারা বাস্তবায়িত না হওয়ার মাশুল রাষ্ট্রকে হয়তো একদিন সেভাবে গুনতে হবে। তত দিনে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় হয়তো বহু জল গড়িয়ে যাবে!
ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক