চ্যাটজিপিটি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেন দরকারি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে? মানুষ কি হেরে যাবে মেশিনের কাছে?
ছবি: এএফপি

চ্যাটজিপিটি বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত একটি নাম। যুগ যুগ ধরে কৃত্রিমতা বর্জন করার আহ্বান শুনে এলেও প্রযুক্তি বিপ্লবের এই বিশেষ সময়ে চলছে বিশেষ এক কৃত্রিমতার জয়গান, সেটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম হলেও ‘বুদ্ধিমত্তা’ বলে কথা।

বুদ্ধিমত্তা এমনই এক অমূল্য সম্পদ, যেটির কৃত্রিম রূপও হয়ে উঠেছে কার্যকর। ওপেনএআই কর্তৃক উদ্ভাবন করা চ্যাটজিপিটি একধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ভাষা মডেল, যেটি মানুষের মতোই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর, ব্যাখ্যা কিংবা পরামর্শ দিতে চেষ্টা করে।

চ্যাটজিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গুরুত্বপূর্ণ এক ধারা ‘মেশিন লার্নিং’ ব্যবহার করে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। একটি শিশু যেমন চারপাশের উদাহরণ থেকে দেখে শেখে, মেশিন লার্নিংও তেমন অতীত ডেটা বা উদাহরণ থেকে শেখে। যে ডেটা দিয়ে মেশিনকে শেখানোর কাজটা করানো হয়, সেটিকে বলা হয় ‘ট্রেনিং ডেটা’। এ রকম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ভাষার মডেল কিন্তু এই প্রথম আমাদের সামনে আসেনি, বেশ কিছু মডেল অনেক দিন ধরে ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (এনএলপি) কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

জিপিটি-৩ ভিত্তিক চ্যাটজিপিটিকে পূর্ববর্তী ভাষা মডেল জিপিটি-২-এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ট্রেনিং ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। মেশিন বা সিস্টেম এই শিখে ফেলা অংশটুকু মনে রাখে বিভিন্ন গাণিতিক সম্পর্ক, সূত্র ও সমীকরণের মাধ্যমে। যেটি কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময় কেউ ইনপুট দিলে সংশ্লিষ্ট সিস্টেমটি আউটপুট দিয়ে থাকে। চ্যাটজিপিটির ক্ষেত্রে ইনপুট হবে ‘প্রশ্ন’, ‘উত্তর’ হবে আউটপুট এবং সিস্টেম হবে চ্যাটজিপিটি নিজেই। জিপিটি-৩-এর গাণিতিক প্যারামিটারের সংখ্যা ১৭৫ বিলিয়ন, যেখানে জিপিটি-২-এর প্যারামিটারের সংখ্যা দেড় বিলিয়ন। একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে না হলেও এই প্যারামিটারের সংখ্যা পরোক্ষভাবে চ্যাটজিপিটির লার্ন করা বা শেখার সক্ষমতা আগের তুলনায় কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে সেটি নির্দেশ করে।

চ্যাটজিপিটির বিশেষত্ব হলো এর ব্যবহারবান্ধব উপস্থাপন এবং ব্যবহারকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মানের উত্তর। যেমন প্রোগ্রামিং কোডের ভুল ঠিক করে দেওয়া, বিশেষ কোনো রীতিতে পদ্য রচনা, একটি নির্দিষ্ট কাঠামো বজায় রেখে বিভিন্ন ফরম বা ডকুমেন্ট প্রস্তুত করে দেওয়া ইত্যাদি। কাছাকাছি ধরনের আরেক সিস্টেম ‘সার্চ ইঞ্জিন’-এর সঙ্গে এটির বিশেষ পার্থক্য আছে। চ্যাটজিপিটির মতো সিস্টেমগুলোয় যে সময় পর্যন্ত নেওয়া ডেটা দিয়ে ট্রেইন করা হয়েছে, তার পরের কোনো তথ্যই তার কাছে থাকবে না, উত্তরও দিতে পারবে না।

সার্চ ইঞ্জিন তাৎক্ষণিক হালনাগাদ তথ্য দিতে পারলেও অনেকগুলো তথ্য বা উৎস এনে উপস্থাপন করে। ব্যবহারকারীদের নিজেদেরই সঠিক এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তর বের করে নিতে হয়। কিন্তু চ্যাটজিপিটি কথোপকথনের মতো ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বার্তার আদান-প্রদান করে। প্রশ্নের উত্তর চ্যাটজিপিটি নিজেই উপস্থাপন করে। এটি একই সঙ্গে সিস্টেমটির সবলতা ও দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক বিশালসংখ্যক ব্যবহারকারীকে (বিশেষ করে নন-টেকনিক্যাল) এটি তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব থেকে যেমন মুক্তি দেয়, তেমনই আবার সংশয়হীনভাবে ভুল তথ্যকেও সঠিক বলে চালিয়ে দেয়।

আলোচনা হচ্ছে এই চ্যাটজিপিটি আমাদের চেনাজানা ইন্টারনেট জগৎকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করে ফেলবে নাকি! লাখ লাখ ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত এটি ব্যবহার করে দেখছেন, অনেকেই অবাক হচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো চ্যাটজিপিটি আসার আগেই ভাষা প্রক্রিয়াকরণ অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল। বহুদিন ধরে গুগল অনুবাদক যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যেকোনো ডিজিটাল বই, ওয়েবসাইট কিংবা লেখাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তর করে ফেলছে, সেটি কি কম অবাক করার বিষয়? এ রকম ভয়েস টু টেক্সট, টেক্সট টু ভয়েস, অনুভূতি বিশ্লেষণ (সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস) ইত্যাদি ভাষা মডেলভিত্তিক আরও বহু উদাহরণ রয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের বিকল্প হয়ে দাঁড়াবে? মানুষ কি হেরে যাবে মেশিনের কাছে? এ রকম নানা ধরনের প্রশ্ন উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের মনে। বস্তুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের বিকল্প হিসেবে না ভেবে সহায়ক হিসেবে চিন্তা করাটাই বাস্তবসম্মত। রাত দুইটার সময় ডক্টরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য তাঁর সহকারীকে বা টিকিট বুকিংয়ের জন্য ট্র্যাভেল এজেন্টকে ফোনে যদি না পাওয়া যায়, সে সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি তার কৃত্রিম কণ্ঠ দিয়েও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পারে বা কম দামে টিকিট কেটে দিতে পারে, ক্ষতি কি? ১০ মিনিট গ্রাহক সেবার লাইনে অপেক্ষা করার চেয়ে, ১০ সেকেন্ডে মেশিন যদি তার যান্ত্রিক ভাষায় অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, সেটি বলে দিতে পারে, ক্ষতি কি?

প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের এক্স-রে, এমআরআই পরীক্ষা করে দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। মেশিন যদি সে মেডিকেল ইমেজ দেখে ইঙ্গিত দিতে পারে, কাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত, ক্ষতি কি?

প্রশ্ন এসেছে, শিক্ষার্থীরা তাদের অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবহারের জন্য চ্যাটজিপিটির মতো সিস্টেম ব্যবহার করে ফেলবে কি না? সেটা কি আদৌ চ্যাটজিপিটি থাকা না থাকার প্রশ্ন? সেটা তো নৈতিকতার প্রশ্ন, ঔচিত্যের প্রশ্ন।

এত দিন গুগল থেকে খোঁজ করেও কি অ্যাসাইনমেন্ট করে ফেলা যেত না? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নতুন উদ্ভাবন, প্রযুক্তি এসব আসবে যাবে, সময় বলে দেবে কোনটি সময়ের স্রোতে তলিয়ে যাবে আর কোনটি টিকে থাকবে। কিন্তু সময় প্রবাহের মধ্যেও ধ্রুব সত্য হয়েই দাঁড়িয়ে থাকবে নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা। শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়, আমাদের প্রয়োজন হবে দায়িত্বশীল (রেস্পনসিবল) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, যেখানে বজায় থাকবে ব্যক্তিগত অধিকার।

আমাদের প্রয়োজন হবে ব্যাখ্যাযোগ্য (এক্সপ্লেইনেবল) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, যেখানে মেশিন কর্তৃক নেওয়া সিদ্ধান্ত বা ভবিষ্যদ্বাণী মানুষ বুঝতে পারবে। আমাদের প্রয়োজন হবে নৈতিক (এথিক্যাল) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, যেখানে কারও প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করা হবে না এবং সমুন্নত থাকবে মৌলিক মূল্যবোধ। আর এ সবকিছু নিশ্চিত করার দায়িত্ব মানুষের, মেশিনের নয়।

  • ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। ইমেইল: bmmainul@du.ac.bd