সাইবার নিরাপত্তা আইন পাসের তাড়াহুড়া উদ্যোগ কী ইঙ্গিত দেয়

বহুল আলোচিত, বিতর্কিত এবং বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নাম বদলের সিদ্ধান্তকে সোমবার সারা দিন কোনো কোনো গণমাধ্যমে আইন বাতিল বলে বর্ণনা করা হলেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমরা বাতিল করছি না। এই আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আইন করছি। নতুন আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব বিধানই থাকছে।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ৭ আগস্ট ২০২৩)। ফলে এ বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমাদের সবার এটা মনে রাখা দরকার, প্রায় ৪ বছর ১০ মাস ধরে এই আইনের যে খড়্গ হাজার হাজার মানুষের ওপরে নেমে এসেছিল, তা অপসৃত হচ্ছে না।

এই খড়গের কোপানলে পড়ে যাঁদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে, তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলাই যুক্তিযুক্ত হবে যে সরকারের এ ধরনের ঘোষণা আশাবাদের জন্ম দেয় না। বরং উল্টো এই ঘোষণা আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং বিভিন্ন রকমের উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে।

সরকারের ঘোষণায় যাঁরা আশবাদী হতে চান, তাঁদের সঙ্গে আমার ভিন্নমত আছে। ২০০৬ সালের আইসিটি অ্যাক্ট ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে ৫৭ ধারার ভয়াবহতার মাত্রা বাড়িয়েছিল। সেই আইনের বিকল্প হিসেবে ২০১৮ সালে এসেছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। স্মরণ করা যায়, ২০১৮ সালে খসড়া আইনের বিভিন্ন ধরনের সংশোধনীর কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সংসদ কেবল পুলিশের করা আপত্তি গ্রাহ্য করেছিল; সম্পাদক-সাংবাদিকদের দেওয়া মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতিও মনে রাখা হয়নি।

প্রস্তাবিত আইন বা সংশোধনীর আশাবাদের জন্ম না দেওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, এই আইনে যাঁরা ইতিমধ্যেই ‘দোষী’ সাব্যস্ত হয়েছেন, কারাভোগ করেছেন, তাঁদের জন্য এই কথিত সংশোধনীতে কিছু নেই। যাঁরা এই আইনের অধীনে অভিযুক্ত হয়েছেন, কার্যত বিনা বিচারে কারাভোগ করছেন, তাঁদের উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ নেই, এমনকি ‘সতর্ক আশাবাদের’ কারণও দেখি না।

ডিএসএর নাম বদলে নতুন মোড়কে আইন করতে সরকার কেন উৎসাহী হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার রাজপথের এবং বিদেশিদের চাপের মুখে আছে। এই মুহূর্তে সরকার বিদেশিদের দেখাতে আগ্রহী যে তাঁরা নিবর্তনমূলক আইন বিষয়ে বিদেশিদের আপত্তিকে বিবেচনায় নিচ্ছে। সম্ভবত সরকার আশা করছে যে এতে বাইরের চাপ কমবে, আলোচনার বিষয় সামান্য হলেও বদল হবে।

আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘এর মধ্যে (অর্থাৎ ডিএসএতে) অপপ্রয়োগের সুযোগ আছে, এমন বিধান সংশোধন করা হয়েছে।’ যদিও মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং গবেষকেরা ২০১৮ সাল থেকেই বলে আসছেন যে এই আইনের চরিত্র এবং প্রকৃতি এমন যে এর প্রয়োগই হচ্ছে ‘অপপ্রয়োগ’। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) পক্ষ থেকে এই আইনের ব্যবহার নিয়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলমান একটি গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দেওয়ার সূত্রে বলতে পারি যে ডিএসএর সবচেয়ে বড় প্রয়োগ হচ্ছে দেশে মতপ্রকাশের অধিকার হরণ এবং দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা।

সরকার কেন এই আইন ‘সংশোধন’ করে নতুন আইন করতে চাইছে, তার কোনো ব্যাখ্যা সুস্পষ্টভাবে দেওয়া হয়নি। দেশে ও দেশের বাইরে যাঁরা ও যেসব মানবাধিকার সংগঠন এই আইন বাতিলের পক্ষে সোচ্চার আছে, তারা আইনটি বাতিল চায় এ কারণে যে এই আইন নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সরকার সেগুলো আমলে নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন মনে করার কারণ নেই। কেননা প্রস্তাবিত আইনের যতটুকু জানানো হয়েছে, তাতে জাতিসংঘের পরামর্শের সামান্য প্রতিফলন দেখা যায় না।

সরকার কেন এই আইন বদলাচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা না দেওয়ায় এই প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক; ‘আইনটি খারাপ, তাই বাতিল হবে; নাকি আইনটিতে নানা রকম অসামঞ্জস্যের কারণে আইনটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারছে না? নাকি সমালোচনার কারণে আইনটি বদলে ফেলা হবে?’ (মো. সাইমুম রেজা তালুকদার, প্রথম আলো অনলাইন ৭ আগস্ট ২০২৩)। সরকার এ প্রশ্নগুলোর উত্তর না দেওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এর কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। এই ব্যাখ্যায় আসব পরে, তার আগেও কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার।

আইনমন্ত্রী বর্তমান আইনের বদলে নতুন আইন করার ঘোষণার সময়ে যা বলেছেন, তার সারবস্তু হচ্ছে কিছু কিছু ধারায় যে শাস্তির বিধান ছিল, তা হ্রাস করা হয়েছে, কিছু কিছু ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২১, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের এসব ধারার শাস্তির মাত্রাই সমালোচনার বিষয় ছিল না। তাই এই উদ্যোগকে আসল বিষয় এড়িয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ করার চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

সরকারের এই প্রস্তাবিত আইনের পুরো ভাষ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিবরণে জানা যাচ্ছে যে ডিএসএর ৪৩ ধারা অপরিবর্তিতই থাকছে। এই ধারা পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পুলিশকে দিয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতার ব্যবহারের উদাহরণগুলো দেখায় যে নিরপরাধ ব্যক্তিরা হেনস্তার শিকার হয়েছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। আইনের আবরণে পুলিশ এসব কাজ করলেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের অগোচরে এসব ঘটার সুযোগ নেই।

নতুন আইনে মানহানির অভিযোগ মোকাবিলায় যেসব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তাতে সাংবাদিকেরা ছাড় পাবেন বলেই বলা হচ্ছে। নতুন আইনে তাঁদের জেলে যাওয়ার বদলে জরিমানা দিতে হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বলেছিলেন যে ডিএসএর আওতায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা হবে না, তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবে আটক করা হবে না। সংবিধান আইনের চোখে সব নাগরিকের সমান অধিকার দেয়, সেখানে এ ধরনের ব্যবস্থা কী করে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সেটা প্রশ্নবিদ্ধই থেকেছে। গত ২৫ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোরের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনে সাংবাদিকেরা খুশি হবেন’ (ডেইলি স্টার বাংলা, ২৫ জুলাই ২০১৩)। এ ধরনের কথা থেকে মনে হয় সরকার আলাদা করে সাংবাদিকদের খুশি করতে চায়।

গোষ্ঠীবিশেষকে খুশি করার এই প্রবণতা আইনের শাসনের পরিপন্থী। ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনেও সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।’ এই বছরের ৪ জুলাই সংসদে এর সংশোধনী পাস হয়েছে, তাতে কার্যত দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের। ফলে সাংবাদিকদের ‘খুশি’ করার চেষ্টা দেখলে উদ্বেগের জন্ম দেয়।

২০১৮ সালে ডিএসএ প্রণয়নের সময় বিভিন্ন মহলের বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে, তাঁদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাঁর পরিণতি কী হয়েছে আমরা জানি। এখন এই নতুন আইনের ব্যাপারে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনাই করা হয়নি। অথচ আইনমন্ত্রী আশা করছেন, সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ‘এই আইন পাস করা হবে’। যে আইনের খসড়া নাগরিকেরা জানেন না, অংশীজনেরা জানেন না, সেই আইন তাড়াহুড়া করে পাস করানোর আয়োজন কিসের ইঙ্গিত দেয়?

ডিএসএর নাম বদলে নতুন মোড়কে আইন করতে সরকার কেন উৎসাহী হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার রাজপথের এবং বিদেশিদের চাপের মুখে আছে। এই মুহূর্তে সরকার বিদেশিদের দেখাতে আগ্রহী যে তাঁরা নিবর্তনমূলক আইন বিষয়ে বিদেশিদের আপত্তিকে বিবেচনায় নিচ্ছে। সম্ভবত সরকার আশা করছে যে এতে বাইরের চাপ কমবে, আলোচনার বিষয় সামান্য হলেও বদল হবে। অন্যদিকে দেশের ভেতরে যখন এই আইন বাতিল কার্যত সবার দাবি হয়ে উঠেছে, তখন এতে সামান্য অদলবদল করে সরকার সম্ভবত এমন আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইছে, যাতে এ ধরনের আইনের আসল উদ্দেশ্যকে আড়াল করা যায়। আবারও স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘নতুন আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব বিধানই থাকছে।’

  • আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট