অভিমত

যেভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন

দেশে মহাসমারোহে আবারও একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অবশ্য ‘অনুষ্ঠিত’ না বলে ‘অভিনীত’ হতে যাচ্ছে বলাই সম্ভবত যথাযথ হবে। এর অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে মঞ্চের সামনের দর্শক এবং পেছনের কলাকুশলীরা—সবাই জানেন, মঞ্চে যা দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে, তা বাস্তবে ঘটছে না।

সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রার্থী, ভোটার—সবাই নিশ্চয়ই জানেন নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে আসলে কী হচ্ছে। কিন্তু তারপরও সরকার পক্ষের চেষ্টা অভিনয়টাকে যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন সাধারণত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত তীব্র হয়, ফলাফল তত অনিশ্চিত হয়। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসন এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করতে স্বস্তি বোধ করে না। সে তখন সব ধরনের অনিশ্চয়তাকে দূর করে দিতে চায়।

নির্বাচনী অনিশ্চয়তা দূর করার একটা উপায় হতে পারে নির্বাচনব্যবস্থাকেই বাতিল করে দেওয়া। কিন্তু নির্বাচন একেবারে বন্ধ করে দিলে দেশে-বিদেশে যে বদনাম জোটে এবং তার ফলে যে ধরনের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়, তা অনেক সময় বেশ ব্যয়বহুল হয়ে যায়। ফলে আধুনিক কালের কর্তৃত্ববাদী শাসকদের জন্য প্রয়োজন এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে নির্বাচন থাকবে কিন্তু নির্বাচনী অনিশ্চয়তাটুকু থাকবে না।

এমন নির্বাচন আয়োজন করা কিন্তু সহজ কোনো ব্যাপার নয়। এই আয়োজনে অভিনয় করার জন্য সরকারি দলের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় ‘উপযুক্ত’ বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে জটিল হলো ‘উপযুক্ত’ বিরোধী দল ম্যানেজ করা।

স্বাভাবিকভাবেই সত্যিকার অর্থে যাঁরা সরকারের বিরোধী, তারা এ ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবেন না। তখন হয় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে প্রবল চাপ তৈরি করে বিরোধী দলকে অংশ নিতে বাধ্য করা হয় অথবা বিকল্প বিরোধী দল তৈরি করে ফেলা হয়।

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ক্রিয়াশীল সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সরকার একটা পর্যায় পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোকে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীন নির্বাচন নাটকে অংশগ্রহণে রাজি করাতে পেরেছে। নির্বাচনের বছরখানেক আগে থেকে বিরোধীদেরকে সভাসমাবেশ করবার সুযোগ দিয়ে গণতন্ত্রের অভিনয়ও করেছে।

বিএনপিকে রাজি করানোর চেষ্টায় প্রবল চাপ তৈরি করেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরেছে, শত শত নেতা-কর্মীকে গায়েবি মামলায় সাজা দিয়েছে।

২৮ অক্টোবর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির অন্তত ৯ হাজার ৮৫৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর—এই ৩ মাসে অন্তত ৪১টি মামলায় বিরোধী দলের ৭১৩ জন নেতা-কর্মীর সাজার রায় হয়েছে। (আরও ৩ মামলার রায়, বিএনপির ৩৯ নেতা-কর্মীর সাজা, প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ২০২৩)

ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে বিএনপি নেতাদের দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশ নিতে দেশের রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করা হয়েছে। এসব করেও তেমন সফলতা আসেনি।

কিন্তু বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন করলে তো তা দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন নাটকে প্রতিযোগিতা যোগ করতে নিজ দলের মনোনয়নবঞ্চিতদের ডামি বা সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে। এই ডামি প্রার্থীদের ‘খেলনা বন্দুকের’ সঙ্গে তুলনা করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘সেই বন্দুক ফোটেও না। ক্ষতিও করে না। তো নির্বাচনে আমরা এমন একটা ডামি ক্যান্ডিডেট রাখব।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাতে করে আন-কনটেস্ট কেউ কোনো জায়গা থেকে নির্বাচিত না হয়। মূলত, আমরা কমপিটিশনের মধ্যে দিয়ে একটা চমৎকার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই।’

নির্বাচনকে এ রকম অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ দেখানোর জন্যই জাতীয় পার্টির মতো মিত্র দল এবং ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের মতো মহাজোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন-সমঝোতা নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি করা হয়েছে। তা ছাড়া বিএনপিসহ মূল প্রতিপক্ষ নির্বাচনে আসছে না—নিশ্চিত হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনও নিশ্চিন্তে কঠোর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন শুরু করেছে, সারা দেশের ওসি ও ইউএনওদের বদলির নির্দেশ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কতটা আন্তরিক!

এ পরিপ্রেক্ষিতে কম্বোডিয়ার নির্বাচনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রধান বিরোধী দল ক্যান্ডেললাইট পার্টির নেতা-কর্মীদের জেলে ভরে ও দেশছাড়া করে এবং দলটিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে ১৭টি ছোট দলকে নিয়ে একতরফা নির্বাচন করেছে কম্বোডিয়ার স্বৈরশাসক হুন সেনের নেতৃত্বাধীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি)।

নির্বাচনে হুন সেনের দল ১২৫টি আসনের মধ্যে ১২০টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর হুন সেন তাঁর পূর্বঘোষণার মতোই ছেলে হুন মানেতের হাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর আগে ২০১৮ সালেও প্রধান বিরোধী দলবিহীন একতরফা জাতীয় নির্বাচনে ১২৫টি আসনের সব কটি কুক্ষিগত করেছিল হুন সেনের নেতৃত্বাধীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারও হয়তো দাবি করবে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও অন্যান্য আরও অনেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, ফলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এভাবে সাজানো প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটাকে বড়জোর আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা বলা যেতে পারে। এই নির্বাচনে যে প্রার্থীই হারুক-জিতুক না কেন, ক্ষমতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত। ফলে এ ধরনের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে জবাবদিহিবিহীন শাসনের যে ভার দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির ওপর চেপে বসেছে, তা থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
    kallol_mustafa@yahoo.com