‘অনেক বছর ধরে বেইজিং বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে ওয়াশিংটনের কর্তৃত্বের ওপর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে।’
‘অনেক বছর ধরে বেইজিং বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে ওয়াশিংটনের কর্তৃত্বের ওপর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে।’

গাজা যুদ্ধে কে জয়ী হবে? অবশ্যই চীন...

গাজায় নারকীয় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধে কে জিতবে আর কে হারবে তা নিয়ে কথা বলাটা রূঢ় শোনাবে। তারপরও এখন যেখানে এই সংঘাত দাঁড়িয়ে, সেখানে বিজেতা তো কেউ আছেই। গাজায় এ পর্যন্ত ২৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬৫ হাজার। ঘরবাড়ি ও স্থাপনার যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা অবর্ণনীয়।

ইসরায়েল হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াটাকেই সফলতা বলে মনে করছে। হামাস তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারাটাকেই সফলতা বলে ভাবছে। কিন্তু এই সফলতা আসছে অসংখ্য মানুষের প্রাণের বিনিময়ে।

ফিলিস্তিনের মতো একইভাবে ইসরায়েলকেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অনেকে মনে করতে পারেন, ইসরায়েলের এই যুদ্ধ গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর বদলা। কিন্তু ব্যাপারটা ইসরায়েলের কাছে আরও অনেক কিছু। এই যুদ্ধে ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে পারেনি। আবার ১৩২ ইসরায়েলি জিম্মিকেও মুক্ত করে আনতে পারেনি। আর বিশ্বে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলায় ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস রায় দিয়েছেন যে গাজায় গণহত্যা ঠেকাতে ইসরায়েলকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এ রায় ইসরায়েলের জন্য অবশ্যই বড় একটা ধাক্কা। পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন ধরে রাখতে পারলেও এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জোর দিয়ে ‘যুদ্ধ চলবে’ বললেও, সেটা এখন পরীক্ষার মুখে পড়ছে।

এই সংঘাতে সবচেয়ে বড় পরাজয় ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে সংকটে পড়ল এবং সেখানে ওয়াশিংটন যেভাবে ভাবমূর্তি খোয়াল, তাতে শুধু আমেরিকাই ক্ষতিগ্রস্ত হলো না, বিপরীতে ব্যাপকভাবে লাভবান হলো প্রতিদ্বন্দ্বী চীন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্পৃক্ততা কমিয়ে আনবে। এক দশকের বেশি সময় আগে তিনি যখন বারাক ওবামা প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে সময়ও তিনি একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যে চীন গভীরভাবে সম্পৃক্ত হলেও, তুলনামূলকভাবে চীন নির্লিপ্ত রয়েছে। চীনের নেতারা যে বিবৃতি দিচ্ছেন, সেখানে ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানানো হচ্ছে এবং এ থেকে বিরত থাকার আহ্বান থাকছে। কিন্তু বেইজিংয়ের বিবৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো, বৈশ্বিক দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রকে খাটো করা। সবকিছু মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে যে গাজা যুদ্ধে যদি কেউ জেতে, তারা হলো চীন।

দ্য নিউ ইয়র্কারের মতে, ওবামা প্রশাসনের মধ্যে বাইডেন ছিলেন মার্কিন সেনাদের ব্যবহারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সংশয়বাদী। মধ্যপ্রাচ্যে সেনা পাঠানো, লিবিয়া ও সিরিয়ায় অভিযান, এমনকি ওসামা বিন লাদেনের হত্যা অভিযানের ব্যাপারেও বাইডেন ছিলেন সংশয়ী। যা হোক, মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সামরিক শক্তি পুরোপুরি প্রত্যাহার না করে সেখানে তাদের পরিমিত অবস্থান এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলনীতি প্রয়োগে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ ছিল বাইডেনের।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বাইডেন এটি অনুশীলন করে চলেছেন। তাঁর কৌশলনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে নেই। এর বদলে এশিয়া ও চীন (ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে শুরু হয়েছিল) তাঁর অগ্রাধিকারে রয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করলে সেই অঞ্চলও বাইডেনের অগ্রাধিকারে চলে আসে। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং সিরিয়া ও ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে যে আলোচনা চলছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলনীতি পরিবর্তনের বিষয়টিকেই স্পষ্ট করে প্রকাশ করে।

কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলকে সমর্থন জোগাতে গিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সেই দীর্ঘমেয়াদি অগ্রাধিকার এখন চাপা পড়তে বসেছে। হিজবুল্লাহকে ঠেকাতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিমানবাহী রণতরি পাঠিয়েছে। লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজে হুতি আক্রমণের প্রেক্ষিতে তারা ইয়েমেনে বিমান হামলা করেছে। ইরাক ও সিরিয়ার ইরান সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপরও হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

আর গত রোববারে জর্ডানে ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সামরিক হামলা বাড়ানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে জর্জ বুশের ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের’ মতো করে বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সামরিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংকট বাইডেনকে তাঁর ঘোষিত কৌশলনীতি থেকে সরে যেতে বাধ্য করছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এরই মধ্যে সতর্ক করেছেন যে গাজা যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে তার দেশ যে যুদ্ধ করছে, সেটি মনোযোগ পাচ্ছে না। তিনি বলেন, গত অক্টোবর মাস থেকে ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব শীতল বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ইউক্রেনকে আরও অর্থ দিতে ইচ্ছুক নয়। এর মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোকে একত্র করার মোক্ষম সুযোগ হারিয়েছেন বাইডেন।

২০২৩ সালের মে মাসে জি-৭ সম্মেলনে বাইডেন খুব সাফল্যের সঙ্গে সদস্যদের ডি-রিস্ক বা ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চীনে বিনিয়োগ না করার ব্যাপারে সম্মতি আদায় করেছিলেন। কিন্তু গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পশ্চিমা মিত্ররা যেন ইসরায়েলে সমর্থন দিয়ে যায়, সেদিকে মূল মনোযোগ দিতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

এ সবকিছুই পশ্চিমা বিশ্বের ও বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক লেখককে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভন্ডামির অভিযোগ আনতে সুযোগ করে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আইনভিত্তিক যে বিশ্ব ব্যবস্থা, তার আইনি ভিত্তিটাই নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। তার কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান একটি মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশাল কোর্ট অব জাস্টিস রায় দিয়েছেন।

২০২২ ও ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো কেন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানাচ্ছে না, তা নিয়ে বারবার আঙুল তুলেছিল। কিন্তু ইসরায়েল যখন গাজায় একই আচরণ করছে, যুক্তরাষ্ট্র তাতে সায় দিয়ে চলেছে। এ ঘটনা বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

এতে করে চীন আবারও লাভবান হচ্ছে। অনেক বছর ধরে বেইজিং বৈশ্বিক নেতৃত্ব হিসেবে ওয়াশিংটনের কর্তৃত্বের ওপর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে।

২০২৩ সালে জোহানেসবার্গ সম্মেলনে ব্রিকস সম্প্রসারণের ঘোষণা দেওয়া হয়। সে সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, ব্রিকসের সম্প্রসারণ অপশ্চিমা বিশ্বের স্বর আরও জোরালো করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করবে।

বৈশ্বিক দক্ষিণের কাছে চীন বারবার এই বয়ান হাজির করছে যে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা যায় না। আর বৈশ্বিক দক্ষিণের একটি দেশ হিসেবে চীন অন্যান্য দেশকে নিয়ে আরও ভালো জোট গড়ে তুলবে। এ উদ্দেশ্যে এরই মধ্যে আফ্রিকার সাব-সাহারা, পূর্ব এশিয়া এবং ইদানীং মধ্যপ্রাচ্যে চীন শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে চীন গভীরভাবে সম্পৃক্ত হলেও, তুলনামূলকভাবে চীন নির্লিপ্ত রয়েছে। চীনের নেতারা যে বিবৃতি দিচ্ছেন, সেখানে ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানানো হচ্ছে এবং এ থেকে বিরত থাকার আহ্বান থাকছে। কিন্তু বেইজিংয়ের বিবৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো, বৈশ্বিক দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রকে খাটো করা। সবকিছু মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে যে গাজা যুদ্ধে যদি কেউ জেতে, তারা হলো চীন।

  • খ্রিস্টোফার ফিলিপস লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত