সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাইড শেয়ারিং পরিষেবায় মানুষ নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাইড শেয়ারিং পরিষেবায় মানুষ নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে

রাইড শেয়ারিং পরিষেবায় কেন ‘কম সময়ে বেশি উপার্জনের’ নীতি

ছোটবেলায় পাবলিক বাসে চড়ার পর সেখানে লেখা থাকা নীতিবাক্যগুলো আমরা একনিশ্বাসে পড়ে ফেলতাম। ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’, ‘ভদ্রতা বজায় রাখুন’, ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’ ইত্যাদি। ভুল-শুদ্ধ বাংলায় লেখা সেসব কথা আমাদের চিন্তার জগতে খানিকটা হলেও দোলা দিয়ে যেত। একেকটা বাস যেন ইশপের নীতিগল্পের একেকটা ছাপাখানা। চালকের ঠিক পেছনের বাক্যটি থাকত, ‘চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলা নিষেধ।’

এখনকার পাবলিক বাসে অবশ্য সেসব লেখা থাকে কম। থাকলেও ‘পাবলিক’ বাসের ‘পাবলিক’ এখন নিমগ্ন থাকে ফেসবুকের ‘পাবলিক’ পোস্ট পড়ায়। তবে পাবলিকের আচার-আচরণে হেরফের হলেও বাসের ভেতরে থাকা সে লেখাগুলোর গুরুত্বের আজও কোনো হেরফের হয়নি। 

২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মর্মান্তিক ট্রাক দুর্ঘটনার কথা মনে আছে নিশ্চয়। ট্রাকটি উল্টে খাদে পড়ে গিয়ে সেদিন নিহত হয়েছিল ৪২ জন, আহত হয়েছিল ১৬ জন। নিহত মানুষের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলছিলেন চালক (তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন, ব্লাস্ট, আসক, ২০১১)।

বর্তমানে সারা বিশ্বে গাড়ি দুর্ঘটনার অন্যতম এক কারণ হয়ে উঠেছে চলন্ত অবস্থায় চালকের মুঠোফোন ব্যবহার করতে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেফটি কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাড়ি চালানো অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার করার কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ৩ লাখ ৯০ হাজারের বেশি মার্কিন নাগরিক আহত হয়, মৃত্যু হয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, মোটরযানচালক মোটরযান চালনারত অবস্থায় মুঠোফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবেন না। গাড়ি চালানো অবস্থায় মুঠোফোনের ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের আইন বলবৎ আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে গাড়ি চালানো অবস্থায় মুঠোফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ।

আবার কিছু কিছু অঙ্গরাজ্যে হ্যান্ডস ফ্রি ডিভাইস ব্যবহার করে, অর্থাৎ সরাসরি মুঠোফোন না ধরে ব্লু–টুথ বা সমজাতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহার করার অনুমতি আছে। তবে পাবলিক বাস চালানোর সময় মুঠোফোনের ডিভাইস ব্যবহার বেশির ভাগ জায়গায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; এসএমএস টাইপ বা পাঠানোর তো প্রশ্নই আসে না। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে গাড়ি চালানো অবস্থায় বন্ধ থাকা মুঠোফোনও হাতে নেওয়া বা পায়ের ওপর রাখা বেআইনি হিসেবে বিবেচিত হয়। 

যে আবিষ্কারের কেন্দ্রে মানুষ নেই, কী হবে সে আবিষ্কারে? যে উদ্ভাবনের মূলে নিরাপত্তার ভাবনা নেই, কী হবে সে উদ্ভাবনে? রাইড শেয়ারের গাড়িতে চলতে চলতে মনে পড়ে আমাদের শৈশবের লক্কড়ঝকড় পাবলিক বাসের কথা, যেখানে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা থাকত, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’

একটা দেশের রাস্তাঘাট, রীতিনীতি, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে এই আইনগুলো কিছুটা এদিক-সেদিক হবে, সেটিই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থা তথা বড় শহরগুলোর ট্রাফিক–ব্যবস্থা আমাদের অজানা নয়। রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলো চালু করেছে ব্যাক টু ব্যাক সার্ভিস। তাদের সাইটে গেলে লেখা থাকে কীভাবে ব্যাক টু ব্যাক ট্রিপ গ্রহণ করা যায়।

বর্তমান ট্রিপে থাকাকালে অপেক্ষা না করে পরবর্তী ট্রিপ গ্রহণ করার মাধ্যমে কীভাবে কম সময় ব্যয় করে অধিক আয় করা যায়। কিন্তু সেখানে উপেক্ষিত থেকে যায় রাস্তায় রাস্তায় আমাদের সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগের দেওয়া স্লোগান, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’ অথবা ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’। কী অবলীলায় ‘চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ’ পরিবর্তন হয়ে রূপ নিল কম সময়ে বেশি উপার্জনে। 

উবারের নীতিমালায় লেখা আছে, চলমান অবস্থায় চালক আরেকটি ট্রিপ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন যদি মুঠোফোনটি নিরাপদ একটি স্ট্যান্ডে লাগানো থাকে, স্কুল চলাকালে স্কুল জোনে বা ফ্রিওয়েতে না থাকে, গাড়ি ৮০ কিলোমিটার বা তার বেশি গতিসীমার রাস্তায় না থাকে, ইত্যাদি।

কিন্তু বাস্তবতা তো আমাদের অজানা নয়। বিকট শব্দে আসা নতুন ট্রিপের কল গ্রহণ করার পর থেকে শুরু হয় অপর প্রান্তে থাকা যাত্রীর সঙ্গে আলাপ। ট্রাফিক আপডেট থেকে শুরু করে কোন মোড়ের, কোন গলির কোন মাথায় যাত্রী আছেন, চলমান ট্রিপ শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে—সবকিছুর একটি নাতিদীর্ঘ কথোপকথন শুরু হয়ে যায়। যেটি সম্পূর্ণরূপে অনিরাপদ এবং গাড়িতে থাকা যাত্রীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। 

চলমান অবস্থায় এ ধরনের কলে স্বাভাবিক দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে চালককে মুঠোফোনের স্ক্রিনে চোখ নিতে হয়, স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে অ্যাপে যেতে হয়, যাত্রীর অবস্থান অনুযায়ী ট্রিপে গ্রহণ করবে কি না, সে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এগুলো করতে হয় খুব কম সময়ের মধ্যে, ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ সেকেন্ডে।

অথচ গ্রাহকের নিরাপত্তা যদি অগ্রাধিকার পেত, একটি ট্রিপ শেষ হওয়ার পর নতুন ট্রিপের কল আসতে পারত। অথবা চালক নতুন ট্রিপের জন্য অপেক্ষা করতে না চাইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালকের জন্য ট্রিপ গ্রহণ করার ব্যবস্থা রাখা যেত। চালকের জন্য সে ট্রিপ অসুবিধাজনক হলে কিছু জরিমানা দিয়ে পরে সেটি বাতিল করতে পারত। এ রকম নানা পদ্ধতি অনুসরণ করা যেত।

এ যুগের অনেক পরিকল্পনায়, অনেক উদ্ভাবনে, কার্যকারিতা বাড়ানোর কথা আছে, ব্যয় সংকোচনের কথা আছে, সময় বাঁচানোর কথা আছে, নেই শুধু ব্যবহারকারীর নিরাপত্তার কথা। যে আবিষ্কারের কেন্দ্রে মানুষ নেই, কী হবে সে আবিষ্কারে? যে উদ্ভাবনের মূলে নিরাপত্তার ভাবনা নেই, কী হবে সে উদ্ভাবনে? রাইড শেয়ারের গাড়িতে চলতে চলতে মনে পড়ে আমাদের শৈশবের লক্কড়ঝক্কড় পাবলিক বাসের কথা, যেখানে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা থাকত, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ 

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

Email: bmmainul@du.ac.bd