গত সপ্তাহে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের রাজধানী জেদ্দায় দুই দিনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশসহ প্রায় ৪০টির মতো দেশ এ সম্মেলনে অংশ নেয়। সম্মেলনে চীন অংশ নেওয়ায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অচলাবস্থা ভাঙার একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।
এর কারণ হলো, জুন মাসের শেষ ভাগে কোপেনহেগেনে একই ধরনের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল চীন। অনেকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, শান্তি স্থাপনে বেইজিং আরও ভালো ভূমিকা পালন করতে চায়, সে কারণেই ওই সম্মেলনে অংশ নেয়নি।
কিন্তু জেদ্দা সম্মেলনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এ সম্মেলনে চীনের অংশগ্রহণের পেছনে ভিন্ন অভিসন্ধি ছিল। সরলভাবে বলা যায়, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা বেইজিংয়ের প্রথম উদ্দেশ্য নয়।
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেইজিং এমন যেকোনো কিছু এড়িয়ে চলছে, যেটা তাদের ‘নিরপেক্ষতা’ নীতির সঙ্গে আপস করতে হয় অথবা কোনো একটা পক্ষ নিতে হয়। নিরপেক্ষতা দেখানোর কারণে কোপেনহেগেন সম্মেলনে চীন অংশ নেয়নি। কেননা, ডেনমার্ক নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটোর সদস্যদেশ।
যদিও রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু ইউক্রেনে সামরিক সমর্থন দেওয়ায় ক্রেমলিন দাবি করে আসছে, এ যুদ্ধে ন্যাটো সম্পৃক্ত। রাশিয়া ছাড়া কোপেনহেগেন সম্মেলনে গেলে চীনের নিরপেক্ষ অবস্থানে কালিমার দাগ পড়ত।
এর বিপরীতে সৌদি আরব দক্ষিণ বিশ্বের মাঝারি শক্তির দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। চীনের দিক থেকে বিবেচনা করলে আয়োজক হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতার বিষয়টা বিবেচনায় নিলে মস্কোকে কৌশলগত মিত্রের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেবে না বেইজিং। এমনকি ইউক্রেনে রাশিয়ার অবস্থান যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তারপরও এ নীতির কোনো হেরফের হবে না। চীনের জন্য ইউক্রেন ও সৌদি আরব তাদের রাজনৈতিক দাবার বড় ঘুঁটি। এর কোনোটিকেই বেইজিং হারাতে চায় না।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সৌদি আরব এ পর্যন্ত রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়ে এবং যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়ে আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাবে ভোট দিতে বিরত থেকেছে। এ ছাড়া রাশিয়া ও সৌদি আরব সম্প্রতি তেল উৎপাদন ও বিশ্বে অপরিশোধিত তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে আরও সমন্বয় করে পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে।
সৌদি আরবের এই অবস্থানের কারণ দেশটি বেইজিংয়ের আরও বেশি স্বাভাবিক মিত্র হতে পেরেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চীন কেন নতুন করে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো?
প্রথমত, জেদ্দা সম্মেলনে চীনের অংশগ্রহণের পেছনে সৌদি আরবের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক আরও মধুরতর করার উদ্দেশ্য কাজ করেছে। রাশিয়াকে নিন্দা জানানো কিংবা ইউক্রেন থেকে রাশিয়া যেন হাত গুটিয়ে নেয়, সে রকম কোনো উদ্দেশ্য বেইজিংয়ের ছিল না।
রাজনীতি, জ্বালানি ও বাণিজ্য এই তিনের ওপর ভিত্তি করে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। চীনের নেতারা বিশ্বাস করতে পারেন, ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রিয়াদের কূটনৈতিক তৎপরতায় সমর্থন জানিয়ে তাঁরা দেশটির প্রিয়ভাজন হতে পেরেছেন।
যদি এই হিসাব ভুলও হয়, তাতেও চীনের কোনো ক্ষতি নেই। কেননা, সম্মেলনে এমন কোনো কথাবার্তা হয়নি, যার জন্য চীনকে বেকায়দায় পড়তে হয়। সম্মেলনটি ছিল শান্তি আলোচনার ব্যাপারে একটি অবস্থানে পৌঁছানো, চুক্তিতে পৌঁছানো নয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে যদি একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারত, তাহলেও সৌদি আরব কিংবা আমন্ত্রিত অতিথি দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারত না।
জেদ্দা সম্মেলন শান্তি স্থাপনে সৌদি আরব যে মধ্যস্থতাকারী দেশ, সেই অবস্থানটি তারা সামনে নিয়ে আসতে পেরেছে। আর বেইজিং মনে করছে, ইউক্রেনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে পারে সে রকম যে কোনো ‘নিরপেক্ষ প্রচেষ্টাকে’ অবশ্যই তাদের সম্মান জানানো উচিত। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যকার বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন মতের উপস্থিতিই বলছে এটি কত নিরপেক্ষ আয়োজন ছিল।
সৌদি আরবের শান্তি প্রচেষ্টায় চীন সমর্থন দিয়েছে। ভবিষ্যতে বেইজিং শান্তি উদ্যোগ নিলে তারা সৌদি আরবের কাছে সমর্থন দাবি করে বসলে সেটা মোটেই বিস্ময়কর হবে না।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সম্পর্কে সম্প্রতি বরফ গলতে শুরু করেছে। এ সময়েই বেইজিং শান্তি সম্মেলনে অংশ নিল। এ বছরের নভেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সান ফ্রান্সিসকো সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এটাকে এ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালে হংকং ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে যে হাঙ্গামার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, তার আগেই দুই দেশ তাদের মধ্যের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক।
পরিশেষে ইউক্রেনে আগ্রাসন থামাতে রাশিয়াকে চেপে ধরার পশ্চিমা প্রচেষ্টায় চীন কিছুটা সহযোগিতা করতে শুরু করেছে। চীনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপটি এ ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম হলেও স্পষ্ট। বেইজিং চীনের ড্রোন, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি যেগুলো সামরিক ও বেসামরিক দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়, সে রকম পণ্য রাশিয়াতে সরাসরি অথবা ইরান হয়ে রপ্তানির ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।
মস্কো কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর চীন ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য (গম, বার্লি ও অন্যান্য প্রধান খাদ্যশস্য) রপ্তানি আবার শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে। বেইজিংয়ের এই আহ্বান প্রকারান্তরে রাশিয়ার সমালোচনা।
সম্প্রতি চীনের দিক থেকে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। মস্কোয় অবস্থিত চীনের দূতাবাস থেকে চীনা নাগরিকদের সঙ্গে বাজে আচরণের অভিযোগে এই অসন্তোষ জানানো হয়েছে। বেইজিংয়ের দিক থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ খুবই বিরল।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে, এ সবকিছুর পরও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে চীনের যে অবস্থান, তাতে কি মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে। এখন পর্যন্ত এর উত্তর হলো না।
সাম্প্রতিককালে চীন এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে রাশিয়ার যুদ্ধ করার সামর্থ্যে ভাটা পড়ে অথবা তাদের আচরণ অর্থবহভাবে পরিবর্তিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতার বিষয়টা বিবেচনায় নিলে মস্কোকে কৌশলগত মিত্রের অবস্থান থেকে সরিয়ে দেবে না বেইজিং। এমনকি ইউক্রেনে রাশিয়ার অবস্থান যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তারপরও এ নীতির কোনো হেরফের হবে না। চীনের জন্য ইউক্রেন ও সৌদি আরব তাদের রাজনৈতিক দাবার বড় ঘুঁটি। এর কোনোটিকেই বেইজিং হারাতে চায় না।
ইয়ান সান ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের চীন কর্মসূচির পরিচালক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত