এমপি-মেয়র দ্বন্দ্বে থমকে আছে দিনাজপুর

বেহাল সড়কই দেখিয়ে দেয় কেমন আছে দিনাজপুর
ছবি: রাজিউল ইসলাম

বাংলাদেশের যেকোনো শহরের সঙ্গে আশপাশের এলাকার পার্থক্যটি বোঝা যায় সড়ক দেখে। পৌর এলাকার বাইরের সড়ক যতই খারাপ থাকুক, শহরের ভেতরের সড়কগুলো থাকে ঝকঝকে। কিন্তু উত্তরের অন্যতম প্রধান শহর দিনাজপুরের চিত্র এর বিপরীত। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর শহর অবধি সড়কটি বেশ ভালো। শহরের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বেশির ভাগ সড়ক খানাখন্দে ভরা। দুই পাশে ময়লা-আবর্জনা।

গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র আয়োজিত একটি কর্মশালায় যোগ দিতে ২২ জুলাই দিনাজপুর যাই। মাসব্যাপী এই কর্মশালার অংশীজনদের বেশির ভাগ ছিলেন প্রধানত স্কুল-কলেজের শিক্ষক। তাঁরা যাতে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে পারেন, সে জন্যই এ কর্মশালার আয়োজন।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সার্কিট হাউসে। পাশেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি গোর-এ-শহীদ ময়দান। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে ময়দানের দেয়ালজুড়ে চলছিল আলোকসজ্জা। একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে আলোকসজ্জা। মনে হলো দেখার কেউ নেই।

দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আয়োজিত কর্মশালা শেষে প্রথম আলোর দিনাজপুর অফিসে গিয়ে দেখি বন্ধুসভার বন্ধুরা অপেক্ষা করছেন। সহকর্মী রাজিউল ইসলাম ওরফে শৈশব রাজু আগেই ব্যবস্থা করেছিলেন। দিনাজপুর বন্ধুসভার সদস্যরা খুবই সক্রিয়। তাঁরা নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন, করোনার সময় মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। প্রথম দিকে অনলাইনে ক্লাস করতে কিছুটা অসুবিধা হলেও পরে সবাই মানিয়ে নিয়েছেন। শিক্ষকেরাও সহায়তা করেছেন। দিনাজপুরের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ শহরের বাইরে থেকে আসা। অনেকেই মেসে থেকে পড়াশোনা করেন। মেসেই প্রথম আলো পত্রিকা রেখে পড়েন। তাঁরাই তো প্রথম আলোর প্রকৃত বন্ধু।

প্রথম আলোর অফিসেই কথা হয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে। কথা হয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের সঙ্গেও।

আওয়ামী লীগ ১৩ বছর ক্ষমতায়। শিল্পকারখানা দূরে থাকে, এখানে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান তারা করেনি। অথচ বিএনপি আমলে এখানে শিক্ষা বোর্ড হয়েছে। জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের হৃদ্‌রোগীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটি। ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত এ হাসপাতাল বিএনপি আমলে প্রচুর সরকারি সহযোগিতা পেত। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তা বন্ধ আছে। তা কি শুধু নামের কারণেই?

জানতে চাইলাম, দিনাজপুরের সমস্যা কী? তাঁরা বলেন, প্রথম সমস্যা ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। দ্বিতীয় সমস্যা অনিয়ন্ত্রিত ইজিবাইক। বাস টার্মিনালগুলো অপরিচ্ছন্ন। কয়েক কিলোমিটার দূরে হিলি সীমান্ত। সেখান থেকে মাদক আসে। তরুণদের একাংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিষ্ক্রিয়। শিশু–কিশোর সংগঠনেরও কোনো তৎপরতা নেই। দিনাজপুরে প্রচুর শস্য, ফল ও সবজি চাষ হয়। কিন্তু কোনো কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠেনি। সেতাবগঞ্জ চিনিকল ও দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলও বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানা বন্ধের মধ্যেই সরকার সমাধান খুঁজছে। লাভজনক করে চালানোর চেষ্টা করছে না।

১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুর পৌরসভার রাস্তাঘাটের এই দুরবস্থা কেন? উত্তরে তাঁরা যা বললেন, তার সারকথা হলো, সদরের এমপি ও হুইপ ইকবালুর রহিম ও পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমের দ্বন্দ্বের কারণে দিনাজপুরের সবকিছু থমকে আছে। কোনো উন্নয়নকাজ হচ্ছে না। নাগরিকদের কল্যাণে নতুন প্রকল্প দূরে থাক, রুটিন কাজগুলোও করা যাচ্ছে না অর্থের অভাবে। দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র বিএনপির। সরকার আওয়ামী লীগের। কাউন্সিলরদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের। এ কারণে মাঝেমধ্যে পৌরসভার কাজকর্মে অচলাবস্থা দেখা দেয়। রাস্তাঘাটে খানাখন্দ থাকলেও মোড়ে মোড়ে হুইপের ছবি–সংবলিত পোস্টার ও ফলক শোভা পাচ্ছে।

তাদের কাছ থেকেই জানলাম, গত ১৫ জুন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কাজে অদক্ষতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মসহ ৯টি অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগ সব মেয়রের বিরুদ্ধেই কমবেশি আছে। তাই বলে তাঁরা বরখাস্ত হন না। বরখাস্ত হন বিরোধী দলের মেয়ররা। উচ্চ আদালতে রিট করে সৈয়দ জাহাঙ্গীর এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছেন। এর আগেও দুবার তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সরকার অযোগ্যতার অভিযোগ এনে সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে বরখাস্ত করে আর জনগণ তাঁকে তিন–তিনবার বিপুল ভোটে মেয়র করেছেন। রহস্যটা কী?

সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি পৌরসভা নির্বাচনেও সৈয়দ জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে প্রায় ২১ হাজার ভোটে হারিয়ে দেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল। স্থানীয় এমপির সমর্থক প্রার্থী নৌকা প্রতীক পেলেও যুবলীগের এক নেতাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পৌরসভার গত ১১ নির্বাচনের একটিতেও আওয়ামী লীগ–সমর্থিত বা মনোনীত প্রার্থী জিততে পারেননি। পাঁচবার জিতেছেন বিএনপি-সমর্থিত বা মনোনীত প্রার্থী। পাঁচবার স্বতন্ত্র প্রার্থী। একবার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী।

দিনাজপুর আওয়ামী লীগ নানা উপদলে বিভক্ত। এক উপদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হুইপ ইকবালুর রহিম। আরেক উপদলে প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী। আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সঙ্গে সদরের বাইরের পাঁচ আসনের এমপির দ্বন্দ্ব এখন আর লুকোছাপার বিষয় নয়। একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি জেলা কমিটি মানেন না। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার তারিখ ঘোষণা করেও জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি।

প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি রাজিউল ইসলামকে নিয়ে ২৩ জুলাই ভোরে যাই শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে রামসাগর দিঘি দেখতে। বাংলাদেশে রাজা-জমিদারদের তৈরি অনেক দিঘি আছে। যার অনেকগুলো দখল হয়ে গেছে। সবুজে ঘেরা রামসাগর এখনো টিকে আছে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন। রামসাগর দিঘি থেকে আমরা গেলাম শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত রাজবাড়িতে। ইলিয়াস শাহীর শাসনামলে রাজা দীনরাজ এটি তৈরি করেছেন। বহু বছর এটি সংস্কার হয়নি, প্রধান ফটক বন্ধ। পর্যটকেরা এলেও ভেতরে যেতে পারেন না।

আমরা যখন দিনাজপুর ছিলাম, তখনই রেলওয়ের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে দিনাজপুর রেলস্টেশন চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে জাগ্রত সমাজকল্যাণ সংস্থা নামের একটি সংগঠন। স্টেশনের পাশেই সংবাদপত্রের এজেন্ট আমিনুল ইসলামের দোকান। সারি সারি পত্রিকা সাজানো। হকাররা তাঁর কাছ থেকে পত্রিকার বান্ডিল নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নারী হকারকেও দেখলাম। চা খেতে খেতে আমিনুলের সঙ্গে আলাপ হলো। পত্রিকার অবস্থা জানতে চাইলে বললেন, করোনাকালে কাটতি কমে গিয়েছিল, এখন আবার পাঠক ফিরে এসেছেন।

দিনাজপুর পৌরসভা ভবনটি মাথার ওপর পড়ো পড়ো অবস্থা। অনেক স্থানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। তারপরও নতুন ভবন নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাই প্রশ্ন করলেন, নিজেদের কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিততে পারেন না। আর সে জন্য সরকার দিনাজপুরবাসীকে শাস্তি দিচ্ছে।

বিএনপি আমলে তো ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে এখানে বিশাল আন্দোলন হয়েছিল। উন্নয়নের দাবিতে কেন আন্দোলন করছেন না আপনারা? তাঁরা বলেন, কীভাবে আন্দোলন হবে। রাস্তায় নামলেই পুলিশের মার খেতে হয়। সাংবাদিকদের ওপরও প্রচণ্ড চাপ।

আওয়ামী লীগ ১৩ বছর ক্ষমতায়। শিল্পকারখানা দূরে থাকে, এখানে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান তারা করেনি। অথচ বিএনপি আমলে এখানে শিক্ষা বোর্ড হয়েছে। জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের হৃদ্‌রোগীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটি। ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত এ হাসপাতাল বিএনপি আমলে প্রচুর সরকারি সহযোগিতা পেত। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তা বন্ধ আছে। তা কি শুধু নামের কারণেই?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com