মতামত

ইসরায়েলের খপ্পর থেকে না বেরোলে পস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

ইসরায়েলি দখলদারি এখন আর শুধু ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নেই। গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যার প্রতি সমর্থন জানিয়ে পশ্চিমা অভিজাতেরা যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতেই বোঝা যাচ্ছে তেল আবিব কীভাবে মার্কিন ও ইউরোপীয় নেতাদের মানসিকতাও দখল করে ফেলেছে।

ফিলিস্তিনি ভূমিতে উপনিবেশ গড়ে তোলার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের বাইরেও ইসরায়েল দখলদারিতে এগিয়ে গেছে। তারা পশ্চিমের রাজধানীগুলোয় এখন রাজনৈতিক বসতি স্থাপন করে ফেলেছে। ইসরায়েলের ওপর হামাস গত ৭ অক্টোবর হামলা চালানোর পর ইসরায়েলের সমর্থনে পশ্চিমারা যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা দেখে মনে হচ্ছে, তাদের মধ্যে এই ইস্যুতে নজিরবিহীন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে তাদের আবেগনির্ভর বক্তৃতা এবং ইসরায়েলের সমর্থনে তাদের বাগাড়ম্বরে একটি বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনে হামলা চালানোকে বৈধতা দিচ্ছে, আবার ইউক্রেনে হামলা চালানোকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলছে।

এক মাস ধরে সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ গাজায় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু ট্র্যাজেডিটি শেষ পর্যন্ত গণহত্যায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমের সাধারণ মানুষ ও তাঁদের নেতৃত্বের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা আছে, তা চলমান এসব বিক্ষোভ থেকে স্পষ্ট হয়েছে।

এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নিষ্ঠুর কথাবার্তায় ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হামলা চালানোর যুক্তিই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাইডেনের এই অবস্থান ইউরোপীয় মন্ত্রীরাও সমর্থন করছেন। তাঁরা গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অসম যুদ্ধ এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অসম যুদ্ধকে সমান চোখে দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা রাশিয়ার আক্রমণকে অন্যায্য বলে দাবি করলেও ইসরায়েলের গণহত্যার নিন্দা জানাচ্ছেন না।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের মিনমিনে প্রতিক্রিয়াকে বিশ্বজুড়ে সংঘটিত অন্যান্য নৃশংসতার বিষয়ে ইসরায়েলের পোষণ করা মনোভঙ্গির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্তেজনা যখন ক্রমেই বাড়ছে এবং পশ্চিমা জোটের মানচিত্রগুলোর যখন রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে মুহূর্তের বাস্তবতা হলো পশ্চিমারা তাদের প্রভাব হারাচ্ছে। সামনের বছরগুলোয় বিশ্বব্যবস্থায় এর যথেষ্ট প্রভাব পড়বে।

যখন গণতন্ত্রের অবক্ষয় বেড়েই চলেছে; যখন জনতুষ্টিবাদের উত্থান অপ্রতিরোধ্য; যখন মানবাধিকার ও সমৃদ্ধির মধ্যকার সম্পর্কের ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না; যখন ভূরাজনৈতিক সহাবস্থান গুরুতর সংকটে পড়ে গেছে; ঠিক সেই সময় পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের পক্ষ নিতে গিয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নির্বিচার জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এর জন্য পশ্চিমকে দিন শেষে চড়া মূল্য দিতেই হবে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকেরা এবং মূলধারার মিডিয়া কি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারি ও গাজায় চালানো গণহত্যার বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ঠিক করে দেওয়া সীমানা অতিক্রম করার সাহস করতে পারবে?

আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো বিক্ষোভ যখন ফুঁসে উঠছে এবং ইসরায়েলের প্রতি যখন জনসমর্থন কমে যাচ্ছে, তখন তেল আবিবের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন কি শেষ পর্যন্ত একটি অভিযোগে পরিণত হচ্ছে না?

এই সংকট ভণ্ডামি এবং দ্বিচারিতাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমারা ইসরায়েলের খপ্পর থেকে নিজেদের বের করে নিতে না পারলে এবং আইনের শাসনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মনোযোগী না হলে সংকট আরও তীব্র হবে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সুস্পষ্ট পথ দেখা যাচ্ছে না। গাজা অধিকৃত পশ্চিম তীর বা বৃহত্তর অঞ্চলে ততক্ষণ টেকসই শান্তি আসবে না, যতক্ষণ না ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক প্রকল্প ফিলিস্তিনিদের (যাদের সংখ্যা ইসরায়েলিদের চেয়ে বেশি) ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। বর্তমানে পশ্চিমের ওপর ইসরায়েলের যে প্রভাব আছে, তা যদি অটল থাকে, তাহলে ওয়াশিংটন এবং ইউরোপের ওপর ইসরায়েলের বোঝা আরও বাড়বে এবং সেখান থেকে পশ্চিম বেরিয়ে আসতে পারবে না।

ইসরায়েলের দ্বারা পশ্চিম মাত্রাতিরিক্ত প্রভাবিত হওয়ার কারণে ইসরায়েলি নেতারা সহজেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর করা যেকোনো অপরাধকে বৈধতা দিতে পারছেন। তাঁরা বহু মানবাধিকার লঙ্ঘনের পক্ষে সাফাই দিচ্ছেন। ইসরায়েলিদের দখলদারির মানসিকতা নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।

যদি ওয়াশিংটন এবং ইউরোপীয় রাজধানীগুলো মনে করে, তারা ইসরায়েলের এই বোঝা কোনো ধরনের প্রতিফলন ছাড়াই বয়ে যেতে পারবে, তাহলে সেটি গুরুতর ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল আরও বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ডেকে আনার আগেই ইসরায়েলের তৈরি করা প্রভাববলয় কেটে পশ্চিমের বেরিয়ে আসা উচিত হবে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • তাহা ওঝান তুরস্কভিত্তিক একজন শিক্ষাবিদ ও লেখক