আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের জন্যই বড় সুযোগ

জ্বালাও-পোড়াও পরিহার করে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারায় ফেরত এসেছে, এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্বস্তির বিষয়। জামায়াতকে তাদের সঙ্গে অন্তত জোটবদ্ধভাবে দেখা যাচ্ছে না, এটাও আশার খবর। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ নামে নির্বাচন কমিশনে যে একটি নতুন দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে, সেটা যে কার খেলা, তা এখনই বলা মুশকিল! জামায়াতের ভোটব্যাংক, অর্থ এবং আন্তর্জাতিক লবিং বিএনপির অনেক বড় পুঁজি। তাদের নিয়োগ করা ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান এখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পৃথিবীর দেশে দেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করে আসছেন, নানা রকমের শুনানি আয়োজন করছেন। কখনো কখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতেরা খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে এসব প্রচারণার প্রতিবাদ করছেন, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো ঘটছে একতরফাভাবে।

জোট কিংবা আসন-সমঝোতায় ২০০১ এবং ২০০৮ সালে যে ৪.৫ শতাংশ ভোট ‘দাঁড়িপাল্লায়’ পড়েছিল, সেটা জামায়াতের প্রকৃত ভোট নয়। ১৯৯৬ সালে আলাদাভাবে নির্বাচন করে যে ৮.৬ শতাংশ ভোট তারা পেয়েছিল, সেটাই তাদের আসল ভোটব্যাংক, যা বিএনপি জোটের মোট ভোটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। তাই বিএনপির পক্ষে জামায়াতকে ছেড়ে আসা সহজ নয়। তা ছাড়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের ‘মডারেট ইসলামি পার্টি’ জামায়াতে ইসলামীর ওপর এখনো তাদের আশা ছাড়েনি। নতুন দলটি কি তবে মার্কিনদের ‘অনূর্ধ্ব পঞ্চাশ জামায়াত’ পরিকল্পনার অংশ? সরাসরি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, তারাতো একই চেতনাকে ধারণ করেই বেড়ে উঠেছে। তাদের রগ কাটার রাজনীতি তো আমরা দেখেছি। নিবন্ধন পেলে তারা কি বিএনপির খোলস ছেড়ে পৃথকভাবে নির্বাচন করবে, নাকি গ্লানি কাটিয়ে আবার চারদলীয় জোটে যোগ দেবে?

এদিকে আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শেষপ্রান্তে এসে স্বাভাবিকভাবেই ‘অ্যান্টিইনকাম্বেসি’ বা পুঞ্জীভূত অসন্তোষ এখন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। সে সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। এ নিয়ে বৈশ্বিক বাস্তবতার যুক্তিতে কোন চিড়া ভিজছে না! ডলার সংকটেও সরকার বড় ধরনের চাপে রয়েছে। নতুন গভর্নর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখলেও, অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ ক্রমেই থমকে যাচ্ছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানির দায় আমাদের আরও এক বছর টানতে হবে, যার অন্তত ২০ শতাংশ ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে পাচার হয়ে গেছে বলেই অর্থ-গোয়েন্দাদের ধারণা।

সরকার তিন মেয়াদে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে শতভাগ বিদ্যুতায়নে বিস্ময়কর সাফল্য দেখালেও, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি নিরাপত্তায় তারা চরম বিপদে পড়ে গেছে। ট্রান্সমিশন লাইন ও গ্যাসের অভাবে অনেক বড় বড় প্ল্যান্টকে বসিয়ে রেখেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী তেলভিত্তিক মেয়াদোত্তীর্ণ রেন্টাল-কুইকরেন্টাল চালিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাতে একদিকে জমছে ‘আইপিপি’দের কাছে দেনা, অন্যদিকে বাড়ছে জ্বালানি আমদানির খরচও। তবে আগামী এক বছরে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ধাপে ধাপে উৎপাদনে এলে, পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। ব্যাংকিং সেক্টরে বেশ কিছু মেগা দুর্নীতির ঘটনায় পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো গুজবে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রীতিমতো টাকা ছাপিয়ে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে, যা সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে!

বিশ্ব খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের কারণে আওয়ামী লীগ খানিকটা বেকায়দায় পড়ে যাওয়ায় বিএনপির সমাবেশে এখন লোক সমাগম বাড়ছে। দলীয় কর্মীরা মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে, আশার আলো দেখছে। ব্যবসায়ীরাও হয়তো বিএনপির জন্য তাদের চাঁদার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে বিভাগীয় জনসভার সাফল্যের পর, বিএনপি ঢাকার মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে হেফাজতি কায়দায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা দখলের যে হঠকারী পরিকল্পনা করেছিল বলে শোনা গিয়েছিল তাতে তারা আবার বহুদূর পিছিয়ে গেছে। পুরোনো পল্টন ছেড়ে ‘গোলাপবাগ মাঠ’ই যখন তারা মেনে নেবে, তাহলে এ নিয়ে এত উত্তেজনা ছড়ানো হলো কেন? মির্জা ফখরুল ও মীর্জা আব্বাসের গ্রেপ্তারের পর আন্দোলন যেরকম তুঙ্গে ওঠার কথা ছিল, তা না হয়ে, নতুন নেতৃত্ব যেন পরিকল্পিতভাবেই সেটা ‘পাংচার’ করে দিল! কিছুদিন পরে তারা একরকম নিভৃতেই জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। বিএনপি নেতাদের কারা জামিন পাচ্ছেন, আর কারা পাচ্ছেন না, কিংবা কখন জামিন পাচ্ছেন, সেখানেও আঁতাতের গন্ধ পাওয়া যায়!

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির ৬ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য শপথ নিলেও মীর্জা ফখরুল কেন নিলেন না, এ রহস্যের জবাব আজও পাওয়া যায়নি। তবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে বিএনপি নেতাদের মুখে যেসব মন্তব্য শোনা যায় তাতে তাদের অবস্থানের খুব বদল হয়েছে বলে মনে হয় না। তাদের ২৭ দফা রাষ্ট্র মেরামত প্রস্তাব আগেই নানা রকম সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এর আগে খোদ খালেদা জিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এবং মীর্জা ফখরুল ‘পাকিস্তান আমলে ভালো ছিলাম’, এমন কথা বলে একই মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের উপনেতা হয়েই মতিয়া চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে নিয়ে যে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন সেটাও দেশবাসীকে চরমভাবে হতাশ করেছে।

আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএনপি অনেক সময় আওয়ামী লীগকেই অনুসরণ করতে চায়। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদ ও রাজপথে যুগপৎ সংগ্রাম চালিয়ে, আন্দোলন তুঙ্গে তুলে, আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে গিয়ে যেভাবে ‘জনতার মঞ্চ’ গড়ে তুলেছিল, সেটা কি এক লাফে ঘটিয়ে ফেলা সম্ভব? তারা সকল বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে ১৪১টি আসনে একযোগে পদত্যাগ করে, সরকারকে যেভাবে ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, বিএনপি মাত্র ৭টি আসন ছেড়ে দিয়ে কি সে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে? তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত আওয়ামী লীগের মতো দলকে কি রাজপথে পরাজিত করা যায়? বিএনপি কাদের ভরসায় তড়িঘড়ি করছে?

যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘ওয়ার অন টেরর’ পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে এখন ‘ওয়ার অন চায়না’ কৌশল গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতার সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে আসছে। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে, হুয়াওয়ে-জেডটিইকে পরিহার করে, ক্লিন নেটওয়ার্কের শর্ত আরোপ করছে। বাংলাদেশকে পশ্চিমা সামরিক জোট কোয়াডেও টানতে চাইছে। কিন্তু সরকার এখনো তার ভারসাম্যের নীতিতে অনড়। মার্কিনিরাই কি তবে বিএনপির আসল ভরসা? কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিএনপিই বা তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হবে কেন? চীন-সৌদি আরব-পাকিস্তানের হাত ধরেই তো দলটির যাত্রা শুরু। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দিয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। পিকিংপন্থী ছাত্রনেতা মির্জা ফখরুলকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিই এত দূর তুলে এনেছে। বিএনপি ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর, তাইওয়ানের সঙ্গে মাখামাখির দায়ে, চীনের এক ধমকেই আমীর খসরু মাহামুদকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।

সরকারের বহু কর্মকাণ্ডেই মানুষের এখন মনোকষ্ট আছে। কিন্তু ‘ভোট’ পুরোপুরি একটি তুলনামূলক বিবেচনা। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে বেছে নেওয়ার মতো কোনো বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা কি তারা হাজির করতে পেরেছে? এ জটিল পৃথিবীতে, কিইবা হবে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কিংবা পররাষ্ট্রনীতি? স্থিতাবস্থা ভাঙতে হলে যে স্বতঃস্ফূর্ত ‘মোমেন্টাম’ সৃষ্টি হতে হয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কি তা কখনো তৈরি করা যায়?

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র যাই বলুক না কেন দশ ট্রাক অস্ত্রের জোগানদাতাদের নিয়ে ভারতই বা কীভাবে স্বস্তিতে থাকবে? নাকি তাদেরকেও এখন ‘চায়না ফোরিয়া’ পেয়ে বসেছে! অন্যদিকে ভারত-চায়নার চলমান কূটনৈতিক সংলাপও উপমহাদেশে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। আর যাই হোক, ভারত নিশ্চয়ই মার্কিনিদের এ অঞ্চলে নাক গলাতে দেবে না! তবে অতিসম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা এবং সফররত সহকারী পররাষ্ট্রসচিব ডোনাল্ড লু’র মানবাধিকার প্রশ্নে র‍্যাবের অভাবনীয় অগ্রগতির সার্টিফিকেটে সরকারের সঙ্গে তাদের একধরনের আপস রফার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বিএনপির আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, অন্তত নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাব আলোচনায় এসেছিল, সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তারা সে পথও রুদ্ধ করে দিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি যে ১০ দফার আন্দোলন করছে, তাতে সমঝোতার কোনো জায়গা রাখা হয়নি। বরং তা তাদের আন্দোলনকে কানা গলিতে নিয়েই ঠেকাবে! বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে যতই মরিয়া হোক, ২০০১ ও ২০০৬ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর, আওয়ামী লীগ কি আবার বেল তলায় যাবে? তবে সুখের বিষয় এই যে, লোক দেখানো হলেও, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সকলের’ স্লোগানটি বিএনপিকে এবার তাদের ঘোষণাপত্রে আনতে হয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক কিছুই এখন মানুষের চাওয়ার মতো করে ঘটছে না, বহু কিছুই হয়তো মেরামত করতে হবে। সংবিধানে এখনো ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্র ধর্মের দ্বন্দ্বসহ আরও বহু বিরোধ রয়ে গেছে। কিন্তু কারা হবে তার কারিগর? বেগম জিয়া কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তার প্রতি মানুষের একধরনের আস্থা ছিল, তিনিও এখন দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত। কিন্তু তারেক জিয়া, যিনি ২০০১ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশের গ্যাস সম্পদ পর্যন্ত বেঁচে দিতে চেয়েছেন এবং ২০০৪ সালে গ্রেনেড মেরে বিরোধী দলীয় নেতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছেন, দেশের মানুষ তার ওপর ভরসা করবে কীভাবে?

বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচন প্রতিহত করার নাশকতায় নেমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালে তাদের আন্দোলনের সমস্ত অর্জন খোয়া গেছে মনোনয়ন বাণিজ্যে জড়িয়ে। ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে তারা চরম ভুল করেছে। এবার তারা প্রকাশ্যে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের ওপর ভর করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে অনেকে এখন কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গের অভিযোগে তুলছেন। রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূতকে সময়ের আগেই দেশ ছাড়তে হয়েছে। মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তড়িঘড়ি করে নতুন রাষ্ট্রদূতকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনারও বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বেশ কিছু প্ল্যাটফর্মে বেফাঁস কথা বলে এখন মৌনব্রত পালন করছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমারা যাদের বন্ধু হয় তাদের আর কোনো শত্রু লাগে না!

বিএনপি লবিষ্ট নিয়োগের মাধ্যমে দেশের বিরুদ্ধে ‘স্যাংশন’ আদায় করে কি মানুষের মন জয় করতে পারবে? তারা এখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছে তাতে বড়জোর আরেকটা ‘এক-এগারো’র পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, কিন্তু নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো পথ আর খোলা থাকবে না! বিএনপির তারেক বিরোধী তরুণ প্রজন্মের নেতারা অনেকেই এখন গোপনে নতুন কোনো মেরুকরণের জন্য কাজ করছেন। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারলে, তাদের উদ্যোগ সহজ হবে। যাদের ধমনিতে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার কুশীলবদের রক্ত প্রবাহিত, দেশবাসীই বা তাদের বিশ্বাস করবে কীভাবে? নতুন পরিকল্পনায় তারা নাকি মার্কিন ও ভারতপন্থী বেশ কিছু চেনা মুখকেও সঙ্গে নিতে চাইছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে বিদেশিরা কতখানিই বা প্রভাব খাটাতে পারবে? সত্তর দশকের জাসদ, আশির দশকের মহিউদ্দন-রাজ্জাকের বাকশাল কিংবা ২০০৬ সালের ‘এক-এগারো’, কোনো পরিকল্পনাই তাদের সফল হয়নি। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসকে দিয়ে যা হয়নি, পিতার হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্তের সঙ্গে জোট গড়া রেজা কিবরিয়া, বিচ্যুত বাম কিংবা ইসরায়েলিদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া ভিপি নুরকে দিয়ে তার কতটাই বা হবে?

সরকারের বহু কর্মকাণ্ডেই মানুষের এখন মনোকষ্ট আছে। কিন্তু ‘ভোট’ পুরোপুরি একটি তুলনামূলক বিবেচনা। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে বেছে নেওয়ার মতো কোনো বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা কি তারা হাজির করতে পেরেছে? এ জটিল পৃথিবীতে, কিইবা হবে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কিংবা পররাষ্ট্রনীতি? স্থিতাবস্থা ভাঙতে হলে যে স্বতঃস্ফূর্ত ‘মোমেন্টাম’ সৃষ্টি হতে হয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কি তা কখনো তৈরি করা যায়? মানুষের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশে কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠল না, যারা হবে আরেক ধাপ অগ্রসর এবং পুরোপুরি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে, ১৫ ও ২১ আগস্টের কালিমা মেখে ফেরারি তারেক রহমানের বিএনপির পক্ষে কি কোনো ‘ভায়েবেল অলটারনেটিভ’ উপহার দেওয়া সম্ভব? দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ইস্যুই তারা সামনে আনছে, তার সবক’টিতেই তারা নিজেরা ছিল আরও এককাঠি সরস! মানুষ কি অপারেশন ক্নিনহার্ট, ২০০১ এর নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, হাওয়া ভবনের কর্মকাণ্ড, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা কিংবা ২০১৩ সালের আগুন-সন্ত্রাস ভুলে গেছে? আর সে জন্যই কি আওয়ামী লীগ চেনা শত্রু হিসেবে বিএনপিকে কোরামিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে, কারণে-অকারণে বিষোদ্‌গার করে তাদেরকে রাজনীতির মাঠে জিইয়ে রাখছে?

কিন্তু রংপুরের নির্বাচন থেকে ক্ষমতাসীনদের কঠিন শিক্ষা নেওয়ার আছে। ভোটারদের মনে বড় কোনো আঘাত না দিয়ে থাকলে, কি করে আওয়ামী লীগের ভোট ৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে? ঠিকঠাক নির্বাচন না হতে হতে মানুষ কি তবে ‘নৌকা’য় ভোট দেওয়াও ভুলে গেছে? ভোটাররা কি তাহলে এবার জিদের ওপরই ভর করবে? তবে সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তার প্রমাণ তারা পুনঃঅনুষ্ঠিত গাইবান্ধা উপনির্বাচনেই রেখেছে। ডিসেম্বরের শেষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতো বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্যানেলের নিরঙ্কুশ বিজয়ে বাতাস ঘুরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

দেশবাসী শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যেমন চরম উচ্ছ্বসিত, ‘অলিগার্কদের’ দৌরত্বেও তারা যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ। তবুও ঘুরে ফিরে আওয়ামী লীগের কাছেই সুরাহা খুঁজছে মানুষ। আজকের বাংলাদেশে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কোনো দূরবর্তী বিকল্পও নেই! উন্নয়নের পাশাপাশি শীর্ষ লুটেরাদের আইনের মুখোমুখি করে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে, তিনি সুশাসনের উজ্জ্বলতম ‘লিগ্যাসি’ রেখে যাবেন, এটাই দেশবাসীর নিশ্চিত বিশ্বাস। কেননা তিনি কেবল আওয়ামী লীগের সভাপতি নন, জাতির জনকেরও সুযোগ্য কন্যা!

গত ১৪ বছর সরকার পরিচালনায় বিপুল সাফল্যের পরও, একতরফা নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে, ২০১৪ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগ কমবেশি বৈধতার সমালোচনায় ভুগেছে। তাই অতি উৎসাহীদের দমন করে, এবারের নির্বাচন হতে হবে, শতভাগ স্বচ্ছ ও প্রভাবমুক্ত। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও, আওয়ামী লীগকে অবশ্যই তাদের সকল সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে আনতে হবে। একটি ভোটও যেন জাল না হয়, এটা এবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাতে ভোটের হার যাই দাঁড়াক না কেন! ইভিএম এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত, কিন্তু ঐকমত্য না থাকায় এবং ডলার সংকটে এবার আর তা হলো না। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি বসানো গেলে প্রক্রিয়াটি আরও নিশ্ছিদ্র হতো। তবে প্রার্থী নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগকে অনেক সতর্ক হতে হবে, প্রয়োজনে অর্ধেক আসনে নতুন প্রার্থী আনতে হবে। ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন প্রার্থী মনোনয়নের পাশাপাশি অন্তত ১০০ আসনে নারী প্রার্থী পুরো ভোটের আবহাওয়াই ইতিবাচক করে তুলতে পারে! মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকেও তাদের এক মঞ্চে আনতে হবে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকিকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত সে প্রক্রিয়াই শুরু করেছেন।

অন্যদিকে বিএনপি এবার যদি দল হিসেবে কোন সাফল্যের মুখ দেখতে চায়, তা তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমেই অর্জন করতে হবে। কেননা বিগত দু’টি নির্বাচনে, ভোট প্রতিহত করা কিংবা ভোটে গিয়ে মাঠ ছেড়ে দেওয়ার উভয় কৌশলেই তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ভোট বর্জন করে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি এমন অভিযোগ তুলে, আর কোনো লাভ হবে না! ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা বহু আগেই আইন করে ওয়াক ওভারের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদেরও এখন এ বিষয়টি বিবেচনায় আনার সময় এসেছে।

গত দেড় দশকে মানুষের জীবন মান উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ হিসেবে, গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হওয়ায়, আগামী বছরের শুরুতে দেশবাসীর পক্ষ থেকে সকল রাজনৈতিক দলের ওপর অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে, তা কোনো দলই উপেক্ষা করতে পারবে না। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদদেরই সমাধান করতে হবে, এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের জন্য সময়োত্তীর্ণ হওয়ার এটাই সবোর্ত্তম সুযোগ! বাংলার মানুষ এবার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সকল কিছু তুল্যমূল্য করেই তাদের মূল্যবান রায় প্রদান করবে, নির্মোহ ভাবেই তাদের যোগ্য নেতৃত্ব বেছে নেবে। এমনকি আসন বণ্টনও তারা কড়ায়-গন্ডায় মিলিয়ে দেবে। সকল সীমাবদ্ধতার পরও, এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি!

  • মোজাম্মেল বাবু কলাম লেখক ও সংবাদমাধ্যম ব্যক্তিত্ব