জো বাইডেন ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
জো বাইডেন ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

মতামত

বাইডেন-নেতানিয়াহু সম্পর্ক যে কারণে ভেঙে যেতে পারে

গাজা উপত্যকায় মিসরের সীমান্তবর্তী রাফার অত্যন্ত জনবহুল ছিটমহলে স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যকার সম্পর্ক ভাঙনের মুখে পড়েছে।

রাফায় ১৪ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থী গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন। ভয়ংকর একটা পরিবেশে তাঁরা সেখানে বসবাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা উপেক্ষা করেই নেতানিয়াহু সেই জনবহুল বসতিতে স্থল আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছেন।

এরই মধ্যে ইসরায়েলের চার মাসের গাজা যুদ্ধ নিয়ে বাইডেন তাঁর সুর বদল করেছেন। তিনি ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘বাড়াবাড়ি’ বলছেন। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ২৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। কমপক্ষে সেখানকার ৬০ শতাংশ বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। ১৮ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে খবর ছড়িয়েছে যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপকালে নেতানিয়াহুকে গালি দিয়েছেন বাইডেন।

রাফায় স্থল অভিযানের যে পরিকল্পনা ইসরায়েল করেছে, সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘের সঙ্গে সৌদি আরব, জর্ডান ও মিসর প্রত্যাখ্যান করে নিন্দা জানিয়েছে। সব পক্ষই এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে যে এ ধরনের বহিরাক্রমণ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। রাফা এখন তাঁবুর শহরে পরিণত হয়েছে। গাজা সিটি, জাবালিয়াসহ অন্যান্য শরণার্থীশিবির থেকে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে রাফায় আশ্রয় নিয়েছেন।

হামাসের সদর দপ্তর আছে—এই অভিযোগ তুলে যে খান ইউনিসকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে, সেখান থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গিয়ে রাফায় আশ্রয় নিয়েছেন। ইসরায়েল এখন বলছে, তাদের রাফায় ঢোকা প্রয়োজন এই কারণে যে সেখানে হামাসের একটি ব্যাটালিয়ন আছে। তারা বলছে যে ইসরায়েল থেকে হামাস যে লোকদের বন্দী করে নিয়ে গেছে, তাঁদের বেশির ভাগকেই রাফায় আটকে রাখা হয়েছে।

রাফা এখন ১৪ লাখের বেশি গৃহহীন গাজাবাসীর আশ্রয়শিবির হওয়া সত্ত্বেও নেতানিয়াহু তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন রাফাকে জনশূন্য করে দিতে।

নির্বাচনের বছরে বাইডেনের জন্য ইসরায়েলের যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ইস্যু। জরিপ বলছে, তরুণ ডেমোক্র্যাট ভোটাররা ইসরায়েলকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা এখনই অস্ত্রবিরতি চান। জরিপ আরও বলছে যে নভেম্বরের নির্বাচনে মার্কিন আরব ও মার্কিন মুসলিমদের ভোট হারানোর ঝুঁকিতে আছেন বাইডেন।

নেতানিয়াহু বলেছেন, রাফার বাসিন্দারা যেন উপত্যকার উত্তর দিকে সরে যান। কিন্তু জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থা সতর্ক করে দিয়েছে যে মানবিক ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছানোর সুযোগ না থাকায় উপত্যকার উত্তর অঞ্চলটা বিরানভূমিতে পরিণত হবে। অপুষ্টি ও নানা অসুখ-বিসুখে জর্জরিত বিপুলসংখ্যক মানুষকে সেখানে স্থানান্তর করা অসম্ভব ব্যাপার।

নেতানিয়াহু বলেছেন, তাঁর সেনাবাহিনীর কাছে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করাটাই অগ্রাধিকার। অথচ সাম্প্রতিক কালে তথাকথিত নিরাপদ জায়গায় যেতে গিয়ে শত শত ফিলিস্তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন।

নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলকে বাইডেন যে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দিয়ে আসছিলেন, তাতে ভারসাম্য আনার জন্য তিনি দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুই রাষ্ট্র সমাধান মানে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

নেতানিয়াহু অবশ্য বাইডেনের এই প্রস্তাবনা খারিজ করে দেন। জর্ডান নদীর পশ্চিম দিকের সব ভূখণ্ডের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন নেতানিয়াহু।

গাজা ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশ হবে এবং হামাসের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নেবে, বাইডেনের এই পরামর্শও নাকচ করে দিয়েছেন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজার ওপর পুরোপুরি ও সুনিশ্চিত নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ চায় ইসরায়েল।

নেতানিয়াহুর জোট সরকারের উগ্র ডানপন্থী সদস্যরা পশ্চিম তীরেও নিরাপত্তা অভিযান চালাচ্ছেন এবং শত শত বেসামরিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছেন, তাঁদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করছেন। ইহুদি বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তিরা সেখানকার আরব বাসিন্দাদের ভেতরে ভয়-সন্ত্রাস তৈরি করছেন।

নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার চরমপন্থী সদস্যরা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করতে এবং তাদের হাতে যেন তহবিল না পৌঁছায়, তার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, অসলো চুক্তির মতো ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি তিনি করবেন না। অসলো চুক্তি থেকেই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের জন্ম।

এ প্রেক্ষাপটে আরব মিত্রদের দিক থেকে চাপের মুখোমুখি হয়েছেন বাইডেন। রাফায় স্থল হামলা হলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি সীমান্ত পেরিয়ে মিসর ও সিনাই উপত্যকায় প্রবেশ করবেন। উদ্বেগ থেকে সীমান্তে ট্যাংক ও বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করেছে কায়রো।

মিসর এরই মধ্যে ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে কথিত ফিলাডেলফি করিডরে ইসরায়েল যদি নিয়ন্ত্রণ নেয়, সেটা তারা কোনোভাবেই বরদাশত করবে না।

সবশেষ সতর্ক বার্তায় মিসর বলেছে, ইসরায়েল যদি সীমা লঙ্ঘন করে, তাহলে দুই দেশের মধ্যকার শান্তিচুক্তি অনিশ্চয়তায় পড়বে।

বাইডেন প্রশাসনের আশা ছিল নেতানিয়াহুকে প্রলুব্ধ করে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনায় নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু ইসরায়েল যদি গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটায় ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করে, তাহলেই কেবল এ ধরনের আলোচনা শুরু হতে পারে বলে জানিয়ে দিয়েছে সৌদি আরব।

যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা এখন মনে করছে যে নেতানিয়াহুর ওপর বাইডেনের কোনো প্রভাব নেই। নেতানিয়াহুর অবাধ্যতা যুক্তরাষ্ট্রের অপমান ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের অপরাধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের জনসাধারণের মধ্যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব উসকে উঠছে এবং লেবানন, লোহিত সাগর, ইরাক ও সিরিয়ায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাইডেন প্রশাসন চায় মধ্যপ্রাচ্যে যেন উত্তেজনা প্রশমিত হয়।

কিন্তু নির্বাচনের বছরে বাইডেনের জন্য ইসরায়েলের যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ইস্যু। জরিপ বলছে, তরুণ ডেমোক্র্যাট ভোটাররা ইসরায়েলকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা এখনই অস্ত্রবিরতি চান। জরিপ আরও বলছে যে নভেম্বরের নির্বাচনে মার্কিন আরব ও মার্কিন মুসলিমদের ভোট হারানোর ঝুঁকিতে আছেন বাইডেন।

  • ওসামা আল-শরিফ, জর্ডানভিত্তিক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া হয়েছে, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত