ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল গত বুধবার। আর হলো তেমন কোনো আপত্তি ব্যতিরেকে এবং অম্লতা ও তিক্ততার সঙ্গে ক্ষোভের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে।
নিহত মানুষেরা তো সব কবরেই চলে গেছেন। লেবাননে ৪ হাজার মরেছে, ইসরায়েলে ১০০ জন। এটাই স্বাভাবিক। আহত ব্যক্তিরা পুনর্বাসনের জন্য লড়ছেন, শোকাহত ব্যক্তিরা মাতম করছেন, ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এই অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের পর কোনোখানেই ভালো কিছু হয়নি, যুদ্ধের আগে পরিস্থিতি যা ছিল, তার চেয়ে ভালো হয়নি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমাপনী মন্তব্যে এটা ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
যুদ্ধবিরতি উপলক্ষে এক হতাশাব্যাঞ্জক ভাষণে নেতানিয়াহু অবশ্য যুদ্ধের অর্জনগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেছেন: ‘আমরা (ইসরায়েলিরা) কতজনকে হত্যা করেছি এবং কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছি যেন রক্তপাত ও ধ্বংসলীলার পরিমাপই এক বিরাট অর্জন।’ ‘
বৈরুতের মাটি প্রকম্পিত হয়েছে’—দম্ভভরে এটাই উচ্চারণ করেছেন তিনি। তাতে কী? এই ভূকম্পন তৈরি করে ইসরায়েলের কী লাভ হয়েছে, শুধু প্রতিশোধের লালসা পূরণ ছাড়া? অস্ত্র ব্যবসায়ী আর সমর বণিকেরা, অন্যদের প্রাপ্তি কী?
লেবানন ও গাজায় ইসরায়েল সামরিকভাবে বিজয়ী হয়েছে, তবে বাকি সব ক্ষেত্রে হেরে গেছে। ইসরায়েলের নেতারা আজ হেগের (আন্তর্জাতিক বিচারালয়) পরোয়ানার সম্মুখীন, দেশটির নাগরিকেরা দুনিয়াজুড়ে একঘরে। গাজা ও লেবাননের যুদ্ধকে ইচ্ছে করে ডেকে আনা হয়েছে। গোড়া থেকেই পরিষ্কার ছিল যে এসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া হয়তো অনুমোদনযোগ্য, তবে একই সঙ্গে ভয়াবহরকম নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
নেতানিয়াহু একমুহূর্তের জন্যও একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের রুপালি আশার রেখা জাগানোর কোনো চেষ্টাই করেননি; বরং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে পরবর্তী দফায় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে কোনো দ্বিধা করবেন না। ইসরায়েলের অভীষ্টই হলো তলোয়ার দিয়ে বেঁচে থাকা, শুধু তলোয়ার দিয়েই চিরকাল বেঁচে থাকা।
বেশির ভাগ ইসরায়েলির মনমানসিকতাও একই রকমের। যুদ্ধবিরতিতে কিছু আপত্তি উঠেছিল। নেতানিয়াহুর অনুগতরাও কষ্ট করেই এটা গিলেছেন, অস্বস্তির লজ্জায় পতিত হয়েছেন। কারণ, আরেকটি যুদ্ধ আপাতত শেষ হলো রাজনৈতিক শিবিরে কোনো জয়োল্লাস ছাড়াই। আসলে আমাদের এই প্রান্তে এ রকম উল্লাস যুদ্ধ শুরুর কালের জন্য সংরক্ষিত, শেষ হওয়ার জন্য নয়।
সংগতভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই সহিংসতার প্রদর্শনী থেকে কী ফায়দা হয়েছে? ইসরায়েল কি আগের চেয়ে এখন নিরাপদ? অর্থনীতি কি চাঙা হবে? মানুষজন উজ্জীবিত হবে? শুধু ক্ষয়ক্ষতির স্তূপই বেড়ে অভূতপূর্ব উচ্চতায় উঠেছে।
প্রথম দিন থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে দুই রণাঙ্গনে (উত্তর সীমান্তে লেবাননে হিজবুল্লাহ আর দক্ষিণ সীমান্তে গাজায় হামাসের সঙ্গে) যুদ্ধ চালিয়ে উত্তম কোনো ভবিষ্যৎ মিলবে না। আর সেটা ঘটে, যখন জনমতের তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। তারা সবাই বলবে, ‘কোনো বিকল্প ছিল না।’
আগে বলেছে, ‘ওরাই শুরু করেছে।’ তারা আত্মরক্ষার দাবি করছে। এগুলো সবই সত্যি বটে, কিন্তু প্রশ্ন হলো: পাইকারি হারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যা নতুন ধরনের অভিযানের পথ খোলা ছাড়া আর কী লক্ষ্য অর্জিত হলো? কী পাওয়া গেল গণহারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, যা এরই মধ্যে দুনিয়াজুড়ে সৃষ্ট ঘৃণাকে আরও বাড়িয়ে দিল?
লেবানন ও গাজায় ইসরায়েল সামরিকভাবে বিজয়ী হয়েছে, তবে বাকি সব ক্ষেত্রে হেরে গেছে। ইসরায়েলের নেতারা আজ হেগের (আন্তর্জাতিক বিচারালয়) পরোয়ানার সম্মুখীন, দেশটির নাগরিকেরা দুনিয়াজুড়ে একঘরে। গাজা ও লেবাননের যুদ্ধকে ইচ্ছে করে ডেকে আনা হয়েছে। গোড়া থেকেই পরিষ্কার ছিল যে এসব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া হয়তো অনুমোদনযোগ্য, তবে একই সঙ্গে ভয়াবহরকম নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
৭ অক্টোবরের পরও গাজায় এ রকম একটা ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়া সম্ভব ছিল, প্রয়োজনীয়ও ছিল। এই যুদ্ধ নিহত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেবে না, জিম্মিদের ফিরিয়ে দেয়নি। একইভাবে সম্ভব ও প্রয়োজনীয় ছিল হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া।
গত মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে যা অর্জিত হলো, তা লেবানন যুদ্ধ না ঘটিয়েও সম্ভব ছিল। আর তা সম্ভব ছিল গাজায় যুদ্ধ থামিয়ে। আর তাই ইসরায়েলের কোনো উপায় ছিল না, এমন যুক্তি মিথ্যা। যখন কেউ দেখছে যে কীভাবে ও কী মূল্যে এটা শেষ হলো, তখন তার ক্ষুব্ধ হওয়ারই কথা। তাই গাজা যুদ্ধে না জড়ালে উত্তর সীমান্তেও যুদ্ধ বাধত না।
প্রিয়জন হারানোর বেদনাগ্রস্ত পরিবারগুলো নিজেদের এই বলে তুষ্ট করার চেষ্টা করছে যে তাদের ছেলেদের মৃত্যু বৃথা যায়নি। কারণ, তারা মাতৃভূমি রক্ষায় প্রাণ দিয়েছে। তাদের সঙ্গে তর্ক করা কঠিন। কিন্তু গাজায় ভয়াবহ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো আর লেবাননে মর্মান্তিক শাস্তি দেওয়ার পর কোন মাতৃভূমির কী সুরক্ষা এল?
ইসরায়েল আসলে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে যা অর্জন করতে চায়, তা হলো, আগামী যুদ্ধের আগপর্যন্ত কিছুটা সময়ক্ষেপণ। অন্য কোনো কিছুর জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই। গাজার বাস্তবতা আরও কঠিন ও জঘন্য। শুধু হত্যা করার জন্যই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে, যার কোনো শেষ নেই। এটা এক সর্বনাশা নীতি।
ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার থাকলেও দুই রণাঙ্গনের কোনোটি এ বিষয়ে নজর দেয়নি। যদি ইসরায়েল নিজেকে সত্যি রক্ষা করতে চায়, তাহলে তার জানা উচিত যে যুদ্ধ শেষে কী অর্জন করতে চায় দেশটি। তার এ নিয়ে কোনো ধারণা নেই। ফলে বৃথা আরেকটি যুদ্ধ হলো। আর এর সমাপ্তিও হলো আংশিক, যা কেউই উদ্যাপন করছে না। হাজার হোক, ইসরায়েল কেবল যুদ্ধই চায়।
গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক। ইসরায়েলের দৈনিক হারেৎজে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া