খবরটি পড়ে আনন্দে মন ভরে গেল। আমাদের এই স্বার্থপর সমাজে এ রকম মহৎ মানুষও আছেন!
যেখানে রাজনীতিকেরা প্রতিপক্ষের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে সদা ব্যস্ত, যেখানে সন্তান বৃদ্ধ মা-বাবাকে ঘর থেকে বের করে দেন, দুর্বল প্রতিবেশীর জমি সবল প্রতিবেশী গায়ের জোরে দখল করেন, ঠিকাদার রাস্তার কাজ না করেই বিল তুলে নেন, সেখানে গাজী কামাল নিজের জমি বিক্রি করে মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্য একটি রাস্তা করে দিয়েছেন। সাত লাখ টাকা খরচ করে।
আমরা বলছি পটুয়াখালীর কৃষক গাজী কামাল হোসেনের কথা। তিনি নিজের জমি বিক্রির টাকা দিয়ে ‘গ্রামীণ রাস্তা’ বানিয়েছেন। জেলার কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রাম থেকে পূর্ব সোনাতলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পেছন পর্যন্ত রাস্তাটি সাত লাখ টাকা ব্যয়ে করে দিয়েছেন তিনি।
প্রথম আলোর কলাপাড়া প্রতিনিধি নেছারউদ্দিন আহমদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কামাল হোসেন সড়কটি নির্মাণ করার জন্য নিজের ৩০ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি ১ হাজার ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের, ১৪ ফুট প্রস্থের এবং ১৪ ফুট উচ্চতার গ্রামীণ রাস্তাটি নির্মাণ করেছেন। গত ২০ জানুয়ারি রাস্তাটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ৫ ফেব্রুয়ারি রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে।
এ ঘটনা থেকে সরকারের উন্নয়নের ফাঁকিটাও ধরা পড়ল। মন্ত্রী-এমপিদের দাবি, তাঁরা সারা দেশকে সড়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কুমিরমারা গ্রাম থেকে পূর্ব সোনাতলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পেছন পর্যন্ত এই নেটওয়ার্কের বাইরেই ছিল। যে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন দুই হাজার মানুষ চলাচল করে, সেই সড়কটি তাঁদের চোখে পড়েনি। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য যাঁরা হন, তাঁরা সব সময় নিজের বাড়ির পাশে রাস্তা করেন, কাজে লাগুক আর না-ই লাগুক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা করোনা মহামারিতেও তাঁরা নিজেদের লোক দেখে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। নিজের লোকদের একটু-আধটু সুবিধাই যদি না দেবেন, তাহলে এত কষ্ট করে চেয়ারম্যান, মেম্বর হলেন কেন?
একটি ঘটনা গাজী কামালকে ওই রাস্তাটি নির্মাণে তাড়িত করেছে। এক বছর আগে তিনি ভেড়ির (ছোট রাস্তা) ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সে সময় এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ভ্যানটি হঠাৎ উল্টে গেলে ওই গর্ভবতী মা ভেড়ির পাশেই সন্তান প্রসব করেন। এই দৃশ্য দেখে গাজী কামালের খুব খারাপ লাগে এবং নিজের টাকায় রাস্তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রতিদিন এ রকম কত দুর্ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটে, আমরা অনেকেই নির্বিকার থাকি। কিন্তু কাজী কামাল নির্বিকার থাকেননি। ভবিষ্যতে যাতে ওই রাস্তা দিয়ে যেতে কেউ দুর্ঘটনার শিকার না হন, সে জন্য রাস্তাটি তৈরি করেছেন তিনি। আমাদের সমাজে এ রকম উদাহরণ আরও আছে। আমরা তাঁদের খোঁজ রাখি না। ক্ষমতার রাজনীতি নামের ব্যাধিটি এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে গাজী কামাল হোসেনের মতো মহৎ মানুষের কথা কেউ জানতে চাই না।
রাস্তা নির্মাণ প্রসঙ্গে গাজী কামাল বলেছেন, ‘আমার হাতে টাকা আছিল না। যে কারণে আমার নিজের ৩০ শতাংশ জমি বিক্রি করতে হইছে। জমি বিক্রির সাত লাখ টাকায় রাস্তাডা নির্মাণ করতে সক্ষম হইছি। এ রাস্তার মাঝখান দিয়ে এখন যদি একটি পানি নিষ্কাশনের জলকপাট করে দেওয়া হয়, তাহলে কৃষকদের অনেক উপকার হবে।’
এর আগে ২০০৭ সালে নিজ অর্থায়নে নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাশ দিয়ে কুমিরমারা খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিয়েছিলেন কামাল হোসেন। ৩৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকোটি তৈরি করতে তখন তাঁর দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। পরে প্রতিবছর সাঁকো মেরামত করতে তাঁর এক লাখ টাকা করে খরচ হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছরে সাঁকোর ওই জায়গায় লোহার কাঠামো দিয়ে সেতু নির্মাণ করে দেয়। এ ছাড়া তিনি এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসায় অর্থসহায়তা, কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাকে আর্থিক সহায়তাসহ জনহিতকর বহু কাজ করেছেন। এসব কাজের জন্য স্থানীয় গ্রামবাসী তাঁকে ২০১০ সালে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেন।
নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বাবুল মিয়াও স্বীকার করেছেন, ‘যে কাজ আমরা করতে পারিনি, তা কৃষক কামাল হোসেন করেছেন। সত্যিই তিনি ভালো কাজ করেছেন। রাস্তাটি নির্মাণ হওয়ায় ওই এলাকার অন্তত দুই হাজার মানুষের কষ্ট দূর হয়েছে। তা ছাড়া এ রাস্তা হওয়ায় ধুলাসার, ডালবুগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, বালিয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দারাও সহজে এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারবে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাতে একটি জলকপাট নির্মাণ করা যায়, সে চেষ্টা অবশ্যই করা হবে।’ কিন্তু চেয়ারম্যান বলেননি, কেন ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে রাস্তাটি তাঁরা করতে পারলেন না।
গাজী কামালের এই মহৎ কাজের পেছনে মায়ের প্রেরণা ছিল। তিনি যখন মাকে ওই অন্তঃসত্ত্বা নারীর কথা বলে তাঁর মনের ইচ্ছাটি জানান, তাঁকে সমর্থন দেন। গাজী কামাল যখন বললেন, রাস্তা করে দেওয়ার মতো টাকা তাঁর কাছে নেই, বাবা বেঁচে থাকলে তাঁকে খাওয়ানোর জন্য তো টাকা খরচ হতো। একজন মা কত মহৎ ও উদার হলে সন্তানকে এ রকম কথা বলতে পারেন। গাজী কামালের স্ত্রী ও সন্তানেরাও জমি বিক্রির খবর জানতে পেরে বাধা দেননি।
আমাদের সমাজে যাঁরা অগাধ সম্পদের মালিক, তাঁরা আরও সম্পদ বাড়ানোর জন্য নানা উপায় খুঁজতে থাকেন। কেউ অপরের জমি দখল করে ধনী হন। কেউ সরকারি প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে। আর কৃষক গাজী কামাল রাস্তা করার জন্য জমি বিক্রি করেছেন। তিনি যে খুব ধনী কৃষক, তা-ও নন। বসতবাড়িসহ তার ২ একর ৩০ শতাংশ জমি ছিল। রাস্তার জন্য ৩০ শতাংশ বিক্রি করে দিয়েছেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গাজী কামাল যে সড়কটি করেছেন, সেটি কিন্তু তাঁর চলাচলের রাস্তা নয়। তিনি কাজটি করছেন পরের স্বার্থে। এই রাস্তা দিয়ে যাঁরা চলাচল করেন, তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র। তাঁরা যেমন নিজেদের টাকায় রাস্তা করতে পারবেন না, আবার সরকারের কাছ থেকে প্রকল্প পাস করানোর মামার জোরও তাঁদের নেই। এ অবস্থায় একজন গাজী কামালই এগিয়ে এলেন। কেবল রাস্তা নির্মাণ নয়, এলাকার মানুষের প্রতিটি বিপদ-আপদে গাজী কামাল গিয়ে হাজির হন। সাধ্যমতো সহায়তা করেন। ২০০৭ সালে তিনি যে সাঁকোটি করেছিলেন, তাতে তাঁর নিজের টাকা খরচ হয়নি। প্রতিবেশীরাই সহায়তা করেছেন। ২০১০ সালে তাঁরাই তাঁকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে দাঁড় করিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছেন। গাজী কামাল পাঁচ বছর সফলতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পরে আর নির্বাচন করেননি। তিনি বলেছেন, নির্বাচন করলে ও নির্বাচিত হলে অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয়। জনগণের কাছে যে ওয়াদা দেওয়া হয়, তা পূরণ করা যায় না। তার চেয়ে নিজের সাধ্যমতো মানুষের কাজ করে যেতে চান তিনি।
গাজী কামাল খুব কষ্ট করে মানুষ হয়েছেন। তাঁর বাবা যখন মারা যান, তখন বয়স ছিল পাঁচ বা ছয় বছর মাত্র। এরপর মানুষের বাড়িতে কাজ করেছেন। আমাদের সমাজে যাঁরা কষ্ট করে বড় হন, তাঁদের অনেকেই অন্যের কষ্ট বুঝতে চান না। কিন্তু গাজী কামাল বুঝেছেন। এ রকম মানুষ আছে বলেই সমাজ টিকে আছে। শাবাশ! কৃষক গাজী কামাল, শাবাশ!
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি