যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের পক্ষে নজিরবিহীন বিক্ষোভ চলছে। ৪০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ শিবির গড়ে তুলেছেন তাঁদের ক্যাম্পাসগুলোতে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না। এ পর্যন্ত সারা যুক্তরাষ্ট্রে নয় শর বেশি শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। এরপরও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাঁবু টানিয়ে বসে পড়েছেন শিক্ষার্থী।
বরং শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করার উসকানি দিচ্ছে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চাইছেন গাজার ওপর ইসরায়েল হামলা বন্ধ করুক। ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র বছরে ইসরায়েলকে তিন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এর পাশাপাশি আর্থিক সহায়তাও করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
আন্দোলনকারীদের মতে, এসব সহায়তা বন্ধের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইসরায়েলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতামূলক গবেষণা, শিক্ষা কর্মসূচি বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলকে কারিগরি, আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেয়, তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
এই আন্দোলনে নানা জাতি, বর্ণ ও ধর্মের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন। এটা কোনো সুনির্দিষ্ট একটি দেশ, জাতি বা ধর্মের অনুসারীরা করছেন না। গণতন্ত্রকামী, উদারপন্থী, মধ্যপন্থী—সবাই মিলেই এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। মূলত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হলেও পরে তা পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই শিক্ষার্থী আন্দোলন পশ্চিমের সমাজে ফিলিস্তিন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলের পরিষ্কার বার্তা বহন করে। এখানে শাসকগোষ্ঠী ও নাগরিক সমাজের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের পক্ষে থাকলেও সাধারণ নাগরিক সমাজ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বছরের পর বছর অর্থ ও সামরিক সমায়তা দিয়ে সংঘাত জিইয়ে রাখার পক্ষে না যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ।
ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে কমছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টিভি নেটওয়ার্কের জরিপকে উদ্ধৃত করে আল–জাজিরা জানিয়েছে, দেশটির ৩২ শতাংশ মানুষ ইসরায়েলকে সহায়তা করার পক্ষে। গত বছরের অক্টোবরে ৪৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ইসরায়েলকে সহায়তা করার পক্ষে ছিলেন। ফলে দেখাই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে দিন দিন ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন বিশেষ করে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন হ্রাস পাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রজন্মগত পার্থক্যও এই আন্দোলন সামনে নিয়ে এসেছে। তরুণেরাই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফিলিস্তিন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরুণেরা বয়স্কদের থেকে অনেক বেশি সহানুভূতিশীল।
যুক্তরাষ্ট্রের একদম ঘরের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী এত বড় বিক্ষোভ গড়ে ওঠা কিছুটা অবাক করার মতোই বিষয় বটে। অকল্পনীয়ও বলা চলে। এটা ইসরায়েলের জন্যও বড় ধরনের হুমকি হতে পারে ভবিষ্যতে। কারণ, ইসরায়েল টিকেই আছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভর করে। যুক্তরাষ্ট্রেই যদি জনমত ঘুরে যায়, তবে ইসরায়েলের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে।
সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি সম্ভবত। এবং আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি বা শুরুতেই দমিয়ে দিতে পারেনি। ইসরায়েলপন্থী শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়েছিল যদিও। কিন্তু খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। পুরো আন্দোলনের মাঠ ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের দখলে চলে গেছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ও ইসরায়েলের বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
এই আন্দোলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধীরা সুযোগ নিতে ভুল করছে না। আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। ইরানের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এখন গণতন্ত্রের সবক শুনতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র দিন দিন পায়ের নিচে জমি হারাচ্ছে।
একটি জিনিস বলতেই হবে, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েই ফিলিস্তিনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েই শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়। এই আন্দোলনের কারণে অনেকের সনদ বাতিল হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে বহিষ্কৃত হতে পারেন। আর্থিক জরিমানার কবলে পড়তে পারেন।
ইতিমধ্যেই অনেকে নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। এসব বিবেচনায় নিয়েই তাঁরা আন্দোলন সৃষ্টি করেছেন ও যোগ দিয়েছেন।
এই আন্দোলনের কারণে সহানুভূতির পাল্লা এখন ফিলিস্তিনের দিকে ঘুরে গেছে অনেকটাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাৎসিদের হাতে অত্যাচারিত হওয়ায় এত দিন ইসরায়েল যে সহানুভূতি পেত, এখন সেই সহানুভূতি ফিলিস্তিনের দিকে চলে গেছে। কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা এ নিয়ে প্রচার ও কাজ করছিল। ফিলিস্তিনিদের মূল যুক্তি ছিল, ইসরায়েল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নির্যাতিত হওয়ার সহানুভূতি নিয়ে একই কাজ ফিলিস্তিনিদের ওপর করছে, যা নাৎসিরা করেছিল। বিশেষ করে চলমান গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ধ্বংসলীলা ফিলিস্তিনিদের যুক্তি ও প্রচারণাকে আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিও অ্যাকশন ফর হিউম্যানিটির জরিপ অনুসারে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা পরিচালনা করছে। ইসরায়েলের গণমাধ্যম হারেৎস জানিয়েছে, গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আটকের পরোয়ানা জারি করতে পারে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত।
শুধু মানবিক সহানুভূতিই নয় বৈশ্বিক বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতিও এই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে। সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা হ্রাস পাওয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। এ অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করা ও বিভিন্ন দেশকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই তরুণ প্রজন্ম ইসলামবিদ্বেষ, পারস্পরিক অনাস্থা ও অবিশ্বাসের সমাজ থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ ধারায় বিভাজিত। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মুসলিম ও অমুসলিম বিভাজন। এত বড় দুটি বিভাজনরেখা নিয়ে কোনো সমাজ বেশি দিন টিকতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিজের অস্তিত্বের জন্য হলেও সমাজ থেকে এই বিভাজনরেখা মুছে দিতে হবে। তরুণেরা সেই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু নিজেদের পরিশোধিত করে শুধরে নিতে পারে। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। রাতারাতি বা হুট করে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপন্থী অবস্থানের পরিবর্তন হবে না। তবে একটি নতুন ধারার সূচনা হতে পারে।
এই আন্দোলনের সরাসরি প্রভাব পরবর্তী নির্বাচনে পরিলক্ষিত হতে পারে। তরুণ ভোটাররা নতুন যুক্তরাষ্ট্র নির্মাণের পথ রচনা করতে পারেন সামনের নির্বাচনে। তরুণদের মনোভাব জো বাইডেনের পুনর্নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন। বাইডেন হারলেই তো ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে আসবেন; ডেমোক্র্যাটদের এই যুক্তি ভোটারদের প্রভাবিত না করতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবেই ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা ইসরায়েলকে সমর্থন করে এসেছে। তাই বাইডেন হেরে গেলে বা ট্রাম্প জিতলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো হেরফের হবে না। আবার তরুণদের এই বিক্ষোভ, হতাশা বা আন্দোলন তৃতীয় কোনো পক্ষকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারবে না। তবে যে–ই ক্ষমতায় আসুক সামনের নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের ভূমিকা রাখতে পারে এই তরুণেরা। আজকে আন্দোলনের মাঠে থাকা শিক্ষার্থীরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমবেশি প্রতিটি যুদ্ধেই হার মানা যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলকে সহায়তার নামে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধের ময়দান থেকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক