কী আশ্চর্য! মানুষ কথা বলতে পারবে না? মানলাম, বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্বের সবচেয়ে ভালো শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে। তাই বলে কি এই পাঠ্যক্রমের উন্নতির আর কোনো সুযোগ নেই?
সেই কথাটা লোকে বলতে পারবে না? অনলাইনে কথা বলায় গারদে পোরা হয়ে গেছে, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে শিক্ষক নেটওয়ার্কের আলোচনাও বন্ধ করতে হবে? তারা কি চোখ মেলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে একবার তাকাল? না কি সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আমাদের শত্রু?
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে হার্ভার্ড-এমআইটি থেকে প্রেসিডেন্টদের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন ৭০ জন কংগ্রেস সদস্য আর ধনকুবেররা, যাঁদের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে। এতে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কারণ একটাই-যেন বাইরের কোনো শক্তি শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে মুক্তচিন্তা, আলাপ-আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দিতে না পারে।
আমাদের ‘মহান’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তো স্বায়ত্তশাসিত। তারা সামান্য একটা সেমিনারের অনুমতিও দিতে পারে না? বাহ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাহ! আপনারা না গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ধারক-বাহক?
কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষক নেটওয়ার্কের আলোচনা বাতিল হলো সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার। প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘উপরের নির্দেশে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনার ভেন্যু বাতিল করল ঢাবি কর্তৃপক্ষ’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিমউদ্দিন খানকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি বলেছে, তাঁরা যখন মিলনায়তনে ব্যানার ঝুলাচ্ছিলেন, তখন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির ফোন করেন। তিনি জানান অনুষ্ঠানের বুকিং বাতিল হয়েছে।
পত্রিকাটি ডিনের সঙ্গেও কথা বলেছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি যে কর্মসূচিতে সরকারবিরোধী কার্যকলাপ ঘটবে। আমরা তাদের অনুমতি দিতে পারি না।’ তাঁকে নাকি একটি উচ্চ মহল থেকে অনুষ্ঠান বাতিল করতে বলা হয়েছে। তাহলে আর কী!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হাল দেখে কাজী নজরুল ইসলামের একটা কবিতার কথা মনে পড়ে। সেই যে সাহেব মোসাহেব কবিতা, ‘সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!/মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে! হুজুরের মতে অমত কার?’ ” আহা! কী চমৎকার।
সরকারের জাতীয় জরুরি সেবা ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল করা যাবে। এমনকি পুলিশ নিরাপত্তাও দেবে। অথচ সভা-সমাবেশের অনুমতি নিয়ে করতে না পারার অজস্র উদাহরণ আছে। হয় সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী, নইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা জ্বী হুজুরেরা ত্রাণকর্তা হিসেবে নেমে এসেছেন। কেড়ে নিয়েছেন মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা। এই মাসেই না আমরা মুক্ত হয়েছিলাম?
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আলোচনায় ছিল আরও একটি কারণে। ইউপিডিএফের চার নেতা-কর্মী হত্যার প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের ক্যাম্পাসে মিছিল করার কথা ছিল। ছাত্রলীগ মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন উদ্বোধন সামনে রেখে ক্যাম্পাসের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর ছবি ও মেট্রোরেলের ছবিসংবলিত ব্যানার লাগিয়েছিল। ওই ব্যানারের কয়েক জায়গা ছেঁড়া দেখে ছাত্রলীগ বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের পেটায়।
যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চুপ। কারণ এসব ক্ষেত্রে তাদের কাজই তো চুপ থাকা। সেই দায়িত্বই যেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। কত উদাহরণ দেব?
৪ ডিসেম্বর বরগুনা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে উদীচীর গান গাওয়ার কথা ছিল। সেই গান গাইতে নিষেধ করায় উদীচী আর অনুষ্ঠানে অংশই নেয়নি। এ নিয়ে বরগুনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা তানজিলা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, গানটি নিষিদ্ধ করা হয়নি। সরকারি অনুষ্ঠান হওয়ায় এই উৎসবে গানটি পরিবেশন করতে মানা করা হয়েছে।
গানটি ছিল, ‘এমন দ্যাশে জনম মোদের, বলিব কি আর ভাই/এক বেলাতে ভাত জোটে তো, অন্য বেলায় নাই/দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া আন্ধার ঘরে ঘরে/করলে নালিশ জুটবে গুলি প্রাণটা যাবে যে বেঘোরে।’
এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মুখে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক জ্যোতিকা জ্যোতি ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন।
সেই পোস্টে তিনি লেখেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে মনগড়া প্রলাপ তো নয়। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে জয়নুলের আঁকা চিত্রকর্মে আমরা বাংলাদেশের যে চেহারা দেখি, ২০২৩ সালে এসে উদীচী তাদের একটা গানের মধ্যে ঠিক তেমন বাংলাদেশের চেহারা তুলে ধরেছে।...অনেকেই নিউজটা শেয়ার দিয়ে উদীচীর সাথে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দয়া করে গানের লিরিক পড়েন, তারপর ভেবে দেখেন এটা কি বর্তমান বাংলাদেশ কি না।’
তা তো বটেই। ডিমের দাম তো কমেছে, আলু-পেঁয়াজ-চিনির দাম বেড়েছে তো কী হয়েছে। পেট ভরে ডিম খেলেই তো হয়। রুটি খায় না তো কেক খাক, এমন আর কি।
একটা সময় শুধু সভা-সমাবেশকে বাধা দেওয়া হচ্ছিল, এখন সভা-সেমিনার-গান-কবিতা কিছুই আর সহ্য হয় না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কাওয়ালির অনুষ্ঠান পর্যন্ত হতে দেওয়া হয়নি। একদল ছাত্র এসে মঞ্চ ও বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে, অতিথিদের জন্য রাখা প্লাস্টিকের চেয়ার ছুড়ে বিতিকিচ্ছি কাণ্ড ঘটায়।
এক কাওয়াল তাঁর শিশুপুত্রকে সঙ্গে করে ‘বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের স্মারক’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। প্রাণভয়ে তিনি পালিয়ে যান। অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানী বিবিসিকে তখন বলেন, ‘অনুষ্ঠানের অনুমতি আগে নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আজই আয়োজকদের অনুষ্ঠানটি বাতিল করতে বলা হয়।’
সেই তো! সেই তো! হুজুরের মতে অমত কার?
অথচ কাগজে-কলমে কত ভালো ভালো কথা লেখা। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার অধিকার মৌলিক অধিকার।
সরকারের জাতীয় জরুরি সেবা ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল করা যাবে। অনুমতি দেওয়ার জন্য মহানগরে পুলিশ কমিশনার আর জেলা পর্যায়ে পুলিশ সুপার অপেক্ষায় আছেন নাগরিকদের।
এমনকি দুই থেকে চার দিন পর্যন্ত পুলিশ নিরাপত্তাও দেবে। অথচ সভা-সমাবেশের অনুমতি নিয়ে করতে না পারার অজস্র উদাহরণ আছে। হয় সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী, নইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা জ্বী হুজুরেরা ত্রাণকর্তা হিসেবে নেমে এসেছেন। কেড়ে নিয়েছেন মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা। এই মাসেই না আমরা মুক্ত হয়েছিলাম?
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক