সরকার মামলায় হারে কেন

প্রীতিভাজন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সম্প্রতি এক লেখায় আক্ষেপ করেছেন যে ইশতিয়াক আহমেদের মতো প্রথিতযশা আইনজীবী নিয়োগ করেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে মামলায় তারা জিততে পারেনি।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মন্তব্য করেছেন, মামলায় পরাজিত হওয়ার আশঙ্কায় রফিকুল ইসলামের মতো সফল আইনজীবীরা আকর্ষণীয় ফি প্রস্তাব করা সত্ত্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মামলা গ্রহণ করেননি। কিন্তু কেন? সরকার মামলায় হারে কেন? এ প্রশ্ন নিয়েই আজকের আলোচনা।

ফিরে যাই ১৯৮৯ সালে। পড়াশোনা শেষ করে সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছি। বিমানবন্দরে নেমেই ট্যাক্সি সার্ভিসের অভাবে যাত্রীদের বিড়ম্বনা চোখে পড়ে। অথচ তখনো বিশ্বের অনেক দেশের বিমানবন্দর থেকে মিটারে অথবা নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রীরা তাঁদের গন্তব্যে যেতে পারতেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজে যোগ দিয়েই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিই। এ ক্ষেত্রে বাধা ছিল (১) গাড়ি আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক ও কর; (২) রেয়াতি হারে ট্যাক্সিক্যাব আমদানি সুবিধার অপব্যবহার; (৩) ট্যাক্সিচালকদের মিটারে যাত্রী পরিবহন নিশ্চিত করা। বিষয়টি নিয়ে গাড়ি আমদানিকারক, ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানি, ট্যাক্সিচালক ও সম্ভাব্য গ্রাহকদের সঙ্গে আলাপ করে প্রস্তাব দাঁড় করাই।

প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রস্তাবের সারসংক্ষেপের অনুমোদন দেওয়ার পর এসআরওর খসড়া তৈরি করে সচিবের অনুমোদন নিই। তারপর এসআরও ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাই। তখন আইন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব (পরবর্তীকালে যুগ্ম সচিব) ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে হাতে ফাইল দিই। তিনি বলেন, ‘ফাইল রেখে যান। পরে যোগাযোগ করেন।’

এসআরও নিয়ে সব সময়ই একটা তাড়া থাকে। আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ ছিল, ‘বসে থেকে হাতে হাতে করিয়ে নেবেন।’ আমি উপসচিবকে তাড়া দিই। তিনি আমাকে বলেন, ‘ডক্টরেট সাহেব, আপনি একটা কিছু লিখলেই তো তা আর আইন বা বিধি হবে না।’ আমি জিব কেটে বলি, ‘স্যার, এটা কী বললেন? আমি রাজস্ব বোর্ডের নিতান্ত কনিষ্ঠ কর্মকর্তা। আমার খসড়া আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সচিব পরিমার্জন করেছেন এবং অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন।’ তিনি বললেন, ওই একই কথা।

আমি কিছু না বলে, বিষণ্নভাবে তাঁর সামনে বসে থাকি। এর মধ্যে তিনি পিয়নকে ডেকে সচিবালয়ের ক্যানটিন থেকে শিঙাড়া আনার জন্য টাকা দেন। নিরাশ হয়ে বলি, ‘স্যার, আমি যাই তাহলে।’

‘শিঙাড়া খেয়ে তারপর যান,’ এ কথা বলে তিনি ফাইল দেখতে থাকেন। পরে শিঙাড়া খেতে খেতে তিনি বলেন, ‘আপনারা ইচ্ছা করছেন ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে ট্যাক্সিক্যাব চালু করতে নীতিসহায়তা দেবেন, উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু ইচ্ছা, সিদ্ধান্ত এবং বিধি ও আইনের মধ্যে পার্থক্য আছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং মানে কেবল দাঁড়ি, কমা, বাক্য সংশোধন নয়; যদিও আমরা সেটাও করে থাকি।

কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ে আমাদের প্রধান কাজ হলো কয়েকটি বিষয় দেখা, যেমন (১) আপনাদের প্রস্তাব সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না! (২) উচ্চ আদালত উক্ত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকলে তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না! (৩) বিদ্যমান কোনো আইনের সঙ্গে ওভারল্যাপ বা সংঘাত আছে কি না! এবং (৪) সাধারণভাবে প্রস্তাবটিতে ন্যায্যতা আছে কি না!’ আমি বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে থাকি এবং আবার কখন আসব, জানতে চেয়ে সময় চাই। তিনি পরদিন দুপুরের পর আসতে বলেন।

আইনের ৯ ও ১০ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। আইনটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। অথচ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে’ বলা হয়েছে। একই সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ১০১ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগ ও ১০৩ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের এখতিয়ার নির্ধারণ করা আছে।

পরদিন মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে সামনে বসিয়ে, বিভিন্ন প্রশ্ন করতে করতে খসড়া সংশোধন করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের নীতিমালার দুই পাতার দীর্ঘ খসড়াকে আমি দুই লাইনে সংক্ষেপ করে দিতে পারি।’ আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, স্যার, কীভাবে?

তিনি হেসে বলেন, ‘আপনারা যত শর্ত দিয়েছেন, এসব মেনে কেউ ট্যাক্সি সার্ভিস চালু করবে না। সোজা বলে দিলেই পারেন—১) সরকার দেশে ট্যাক্সিক্যাব উৎসাহিত করা ও এ জন্য আমদানি করা গাড়ির জন্য শুল্ক ও কর রেয়াতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২) তবে শুল্ক ও কর রেয়াত পাওয়ার জন্য ১৩টি শর্ত পূরণ করতে হবে!’ যাহোক, তিনি আমাদের খসড়াটি উপযুক্ত সংশোধন করে বোর্ডে পাঠিয়ে দেন।

আসলেই হয়েছিল তা-ই, আমার খসড়ার ওপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একের পর এক শর্ত যোগ করেছিলেন। ফলে এসআরও জারি হওয়ার পর কেউ রেয়াতি সুবিধা গ্রহণ করে ট্যাক্সি আমদানি বা সার্ভিস চালু করেনি। প্রথমে কাটখোট্টা মনে হলেও পরে অনেকবার মন্ত্রণালয়ে মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বুঝতে পারি, তিনি যথার্থ পেশাদার, রসবোধসম্পন্ন ও স্নেহপরায়ণ ব্যক্তি।

জানি না, এখন প্রস্তাবক মন্ত্রণালয়, এমনকি আইন মন্ত্রণালয়েও মুস্তাফিজ ভাইয়ের মতো পেশাদার কর্মকর্তা আছেন কি না, যাঁরা ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে বিধি ও আইনের পার্থক্য বোঝেন। দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০

উক্ত আইনের ৯ ও ১০ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। আইনটির ৯ ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। অথচ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে’ বলা হয়েছে। একই সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ১০১ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগ ও ১০৩ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের এখতিয়ার নির্ধারণ করা আছে।

এ ছাড়া উক্ত আইনের ১০ ধারায় করা সব কাজের জন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ দায়মুক্তির ক্ষেত্র বিষয়ে সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। আইনের ৩ ধারা যেখানে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬-কে আলোচ্য ক্ষেত্রে অকার্যকর করা হয়েছে এবং ৫(২) ধারায় প্রতিযোগিতাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে যা পাবলিক প্রকিউরমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার আবশ্যকতার বিষয়ে ইংলিশ ল’র অধীন বিভিন্ন দেশে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়।

অথচ বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা এ আইনের ফলাফল আমরা জানি। এর ফলে বিদ্যুৎ–ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন তো হয়ইনি বরং বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগ উঠেছে। তাই দেখা যাচ্ছে সংবিধান ও অন্যান্য প্রচলিত আইন উপেক্ষা করে গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রণীত আইন জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।

শূন্য এবং অকার্যকর

দ্বিতীয় বিষয়টি আমার নজরে এনেছেন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে কাজ করেছেন, এমন একজন কর্মকর্তা। আমাদের বিভিন্ন আইনে ‘শূন্য এবং অকার্যকর’ (নাল অ্যান্ড ভয়েড) শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ আয়কর আইন, বিবাহবিচ্ছেদ আইনের কথা উল্লেখ করা যায়। অথচ এসব শব্দগুচ্ছ ব্যাখ্যামূলক, যা উচ্চ আদালতের এখতিয়ার। এভাবে আরও বিভিন্ন আইনের উদাহরণ টানা যায়, যেখানে মুস্তাফিজ ভাই উল্লেখিত আইন ও বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতাগুলো প্রতিপালিত হয় না। ফলে সেসব আইনের বিষয়ে মামলার সিদ্ধান্ত সরকারের বিপক্ষে যায়।

মামলার সিদ্ধান্ত সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার আরও অনেক কারণ আছে। সরকারি দপ্তর ছাড়া আদালতের ব্যর্থতাও উল্লেখযোগ্য। তবে শেষোক্ত বিষয়ে আলোচনার পরিবেশ তৈরি হয়নি।

তা ছাড়া আদালত বিষয়ে আমার জ্ঞানও সীমিত। তবে ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ অনতিবিলম্বে বাতিল করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত আইন প্রণয়নে বিরত থাকা উচিত।

পরিশেষে মুস্তাফিজ ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ