পাঠক সৃষ্টি: আগায় না, পানি ঢালতে হবে গোড়াতেই

আলোচকেরা বলছিলেন, আজ চারদিকে অবক্ষয়, যে ভাঙনের শব্দ, মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, অতিকেন্দ্রিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব; তার কারণ সৃজনশীলতা চর্চার বিমুখতা।
ছবি: প্রথম আলো

আয়োজনটা দৃশ্যত চমৎকার ছিল। লম্বা একটি টেবিলের চারপাশ আলোকিত করে বসেছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতি, গ্রন্থাগার, প্রকাশনা ও গণমাধ্যম জগতের মানুষেরা। ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও। আলোচনার বিষয়, ‘পাঠক সৃষ্টিতে কার কী করণীয়। এই মুক্ত আলোচনার আসর বসেছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে, ১ জুন বেলা ৩টায়।

যেকোনো আলোচনায় করণীয় তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। এর জন্য চিন্তা করতে হয়। সংকট ও পরিস্থিতি তুলে ধরা বরং সহজ। আলোচনা সে পথেই যাচ্ছিল। সংলাপের আয়োজক জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, সংকটের কথা জানা আছে ঢের, বরং সুপারিশ তুলে ধরার দিকে জোর দিতে চান তাঁরা।

তবে তা বললে কি আর চলে! ভাবনার নানা শাখা-প্রশাখা থেকে পরিস্থিতি তুলে আনারও দরকার আছে। যত গভীর থেকে পরিস্থিতি তুলে আনা যাবে, সমাধানের পথের দিশা দেওয়াও ততটা যুক্তিযুক্ত হবে।

একজন গণমাধ্যমকর্মী ও গ্রন্থাগার–গবেষক হিসেবে ওই সংলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সার্বিকভাবে মনে হলো, আলোচকদের ভাবনাচিন্তা সঠিকভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। তাই প্রথম আলো অনলাইনের মতামত কলামকে বেছে নিলাম।

২.
আলোচনায় কারা ছিলেন, তাঁদের নাম-পরিচয় শুরুতে জানিয়ে দেওয়া ভালো। প্রধান অতিথি ছিলেন সুব্রত বড়ুয়া, যিনি একজন সাহিত্যিক এবং কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক। একে একে কিছু নাম বলে যাই—ফারুক মাহমুদ, ঝর্ণা রহমান, তুষার দাশ, ফরিদ কবির ও সাখাওয়াত টিপু। তাঁরা সবাই কবি, লেখক ও চিন্তক। প্রকাশকদের মধ্যে ইউপিএলের স্বত্বাধিকারী মাহরুখ মহিউদ্দিন, ভাষাচিত্রের খন্দকার সোহেল। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুব্রত ভৌমিক, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক, শিশু একাডেমির মহাপরিচালক ছড়াকার আনজীর লিটন, বাংলা একাডেমির পরিচালক মোবারক হোসেন, এখানকার কর্মকর্তা মামুন সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোস্তাক গাউসুল হক। এই শহরে গ্রন্থাগার পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ সেই মো. জহির উদ্দিন, মো. শাহনেওয়াজ, আনিসুল হোসেন, কাজী সুলতান আহমেদ, আশিকুর রহমান, এহতেশাম খান সিদ্দিকী, আবু সুফিয়ানসহ অনেকেই আলোচনায় অংশ নিলেন সোৎসাহে।

৩.

আলোচনা পর্বে আসা যাক। সবাই একমত যে শুকিয়ে যাওয়া গাছের আগায় পানি ঢেলে ফল লাভ হবে না। তাই পানি দিতে হবে গোড়াতেই। সৃজনশীল বই, অনেক অভিভাবকের কাছে যা ‘আউট বই’ নামে পরিচিত, তা পাঠের ব্যবস্থা থাকতে হবে পাঠ্যক্রমের মধ্যেই। পাশাপাশি সহপাঠ নামের যেসব বই রয়েছে, সেগুলোতে আরও জোর দিতে হবে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ওপরের শ্রেণিগুলোতে পাঠাগারবিষয়ক প্রবন্ধ থাকতে হবে। ছুটির সময় শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বই পাঠবিষয়ক অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন। বাইরের অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা আছে।

আলোচনায় উঠে এল, কেবল টেক্সটবুক পড়ে জিপিএ-৫ পাওয়া যাবে, একসময় তাতে চাকরিও মিলবে। কিন্তু সেই ব্যক্তির দেশ, সমাজ-সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের প্রতি অনুভূতিসম্পন্ন হওয়া কঠিন। আজ চারদিকে অবক্ষয়, যে ভাঙনের শব্দ, মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, অতিকেন্দ্রিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব; তার কারণ সৃজনশীলতা চর্চার বিমুখতা।

আজকের বাংলাদেশের নামী লেখকদের অনেকেরই প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছে স্কুল ম্যাগাজিনে। ফরিদ কবির তেমনটাই বলছিলেন। অথচ আজ বেশির ভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষই এ বিষয়ে উদাসীন। শিক্ষকদের মধ্যে কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না।

৪.
ঢাকা শহর বাড়ছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প, কন্ডোমিনিয়াম। বেইলি রোডে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আবাসিক এলাকায় চমৎকার পাঠাগার আছে। পাঠাগার স্থাপন না করলে নতুন কোনো হাউজিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হবে না, এমন প্রস্তাব রাখার সুপারিশ এল। একজন বললেন, উন্নত সংস্কৃতির সমাজ গড়তে হলে প্রতিটি শপিং মলেও বই পড়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৫.
আলোচনায় উঠে এল পাঠক সৃষ্টিতে আমাদের কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের ভূমিকা। লেখকদের মধ্যে অনেকেই বিচ্ছিন্ন। তাঁরা যাঁর যাঁর গণ্ডিতে বিচরণ করেন। কিন্তু তাঁরা চাইলে স্থানীয় পাঠাগারগুলোতে সময় দিতে পারেন। এতে পাঠকের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ, মতবিনিময়ের সুযোগ ঘটবে। বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সেতুবন্ধ রচনা করে তো পাঠাগারগুলোই।

একবার একটি জেলা শহরের পরিচিত এক পাঠাগারের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর শহরে নামী একজন লেখক বাস করেন। তিনি নাম বলতে পারবেন কি না। পারেননি তিনি। এর জন্য পাঠাগার সভাপতি যতটা দায়ী, ওই লেখকও কম দায়ী নন। বিচ্ছিন্নতা শেষ পর্যন্ত কোনো ফল বয়ে আনে না।

পাঠক সৃষ্টিতে প্রকাশকদের ভূমিকার কথাও উঠে এল। ভাষাচিত্রের তরুণ প্রকাশক খন্দকার সোহেল বললেন, প্রকাশনা এখন সাপ্লাইমুখী, পাঠকমুখী নয়। আর সরকারিভাবে কোনো বই কেনা হয় না, কেনা হয় লেখক ও প্রকাশক। একজন বললেন, সরকারি বই ক্রয়ের তালিকায় দেখা যায় সংকলিত বইয়ে সয়লাব। আলোচনায় উঠে এল, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বছরে একবার বই কেনে, এটা পরিহার করে প্রতি মাসেই কিছু কিছু করে কেনা যেতে পারে। বই ক্রয়ের তালিকায় তরুণ লেখকদের বই যুক্ত করা হয় না। কিন্তু কেন?

সরকার কেন শুধু ছাপানো বই কিনবে? সরকারকে ই-বুক, অডিও বুক, ভিডিও বুক—এসবও ক্রয় করে পাঠকের সামনে কীভাবে হাজির করা যায়, তা ভাবতে হবে।
পাঠক সৃষ্টিতে প্রকাশকদের সঙ্গে পাঠাগারগুলোরও একটা সংযোগ দরকার। তাঁরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের একটি কপি পাঠাগারে দিতে পারেন। অথবা হ্রাসকৃত মূল্যে দেওয়ার উদারতা দেখাতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ প্রকাশকেরই পাঠাগারগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।

বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে প্রকাশকদের আরও যত্নবান হওয়া, উন্নতমানের না হলে সে পাণ্ডুলিপি প্রকাশ না করার কথাও উঠে এল। মাহরুখ মহিউদ্দিন বললেন, পাঠক সৃষ্টি করতে হলেও ব‌ইয়ের মানের প্রশ্নে কোনো আপস করা যাবে না। সেই সঙ্গে ব‌ই নিয়ে চর্চা ও ব‌ইয়ের প্রচারের ওপর জোর দিতে হবে। তাঁরা সেই চেষ্টাই করেন।

সুব্রত বড়ুয়া নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সত্তরের দশকেও যেখানে তাঁর একটি ব‌ই ২ হাজার ২৫০ কপি ছাপা হতো, সেখানে এখন হয় মাত্র ২৫০ কপি। তাও ঠিকমতো বিক্রি হয় না। এ বিপর্যয়ের জন্য মানহীন ব‌ইও কম দায়ী নয়। একজন আলোচক বললেন, আমাদের এত প্রকাশক দরকার নেই, এত বইও দরকার নেই।

আলোচনায় প্রবীণদের কেউ কেউ ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের কথা বললেন। বললেন, এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা রাখতে হবে। আবার অভিভাবকদের বড় অংশ ফেসবুকে আসক্ত। একজন আলোচক বললেন, অভিভাবকদের বই পড়ানোর জন্যও পরিকল্পনা দরকার।

ফেসবুক প্রসঙ্গে তরুণ আলোচকদের পক্ষ থেকে বলা হলো, পাঠক সৃষ্টিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা বরং এখন ভাবার সময় এসেছে।

গণমাধ্যমকে সেরা বইগুলোর খবর পাঠকদের জানাতে হবে। বই আলোচনা লেখার প্রচলিত ধরন বদলাতে হবে। ভালো বই আলোচনা বেশি করে শেয়ার করতে হবে। গণমাধ্যমকে ভালো বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে হ্রাসকৃত মূল্যে। বিপরীত কথাও এল। কবি সাখাওয়াত টিপু বললেন, প্রকাশকেরা কেন গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করবেন? তারা নিজেরা কেন ভালো মানের ওয়েবসাইট তৈরি করেন না?

৬.
সরকারি-বেসরকারিভাবে বই পড়ানোর যত উদ্যোগ আছে, তাতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কীভাবে নিবিড়ভাবে যুক্ত করা যায়, সে প্রসঙ্গও এল। কারণ, এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে বাইরে রেখে কোনো উন্নয়নকাজ হতে পারে না। একটি পাঠাগারের সভাপতি বললেন, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো, সৃজনশীল বইপাঠে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে নেই। রবীন্দ্র-নজরুল-আল মাহমুদ পাঠে তাঁরা এগিয়ে আছেন।

উঠে এল গণমাধ্যমের ভূমিকাও। গণমাধ্যমকে সেরা বইগুলোর খবর পাঠকদের জানাতে হবে। বই আলোচনা লেখার প্রচলিত ধরন বদলাতে হবে। ভালো বই আলোচনা বেশি করে শেয়ার করতে হবে। গণমাধ্যমকে ভালো বইয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে হ্রাসকৃত মূল্যে। বিপরীত কথাও এল। কবি সাখাওয়াত টিপু বললেন, প্রকাশকেরা কেন গণমাধ্যমের ওপর নির্ভর করবেন? তারা নিজেরা কেন ভালো মানের ওয়েবসাইট তৈরি করেন না?

অপর দিকে পাঠাগারের সভাপতিরাও একমত হলেন। হাজারখানেক বই, আর খানদশেক চেয়ার-টেবিল জোগাড় করে একটা রুম ভাড়া নিয়ে বসে পড়ার দিন শেষ। পাঠাগার আধুনিকায়ন করতে হবে। পাঠাগারের সেরা বইগুলোর তালিকা প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠকের সামনে হাজির করতে হবে। থাকতে হবে কম্পিউটার, প্রিন্টার, ফটোকপির ব্যবস্থা। সর্বোপরি বাড়াতে হবে আইসিটি সুবিধা। নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজনের পাশাপাশি ইতিহাস-সংস্কৃতির আলোচনা, বিশ্বসাহিত্যের প্রধান কবি-লেখকদের জন্ম-মৃত্যুর দিন পালন করতে হবে। সারা বছরই পাঠককে সম্পৃক্ত রাখতে হবে।

আর প্রতিটি পাঠাগারেরই থাকতে হবে নিজস্ব বক্তব্য, নিজস্ব চিন্তা-দর্শন, অতীতে যা ছিল। সেই চিন্তা ও মতপন্থী লোকেরাই সেই পাঠাগারে যেতেন। এখন তেমন না হলেও অন্তত নিজস্ব বক্তব্য থাকতেই হবে।

এতসব আয়োজন করার জন্য চাই অর্থ। তা আসবে কোথা থেকে? এ জন্য প্রস্তাব এল, যাঁরা পাঠাগার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত, সেসব স্বেচ্ছাসেবীকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। স্থানীয় যেকোনো উন্নয়নমূলককাজে তাঁদের যুক্ত করতে হবে। আর সক্রিয় পাঠাগারগুলোর জন্য বাড়াতে হবে বিপুল বরাদ্দ। সৃজনশীল মানুষ গড়তে রাষ্ট্রকে খরচ করতে হবে দুই হাত ভরে।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    alim.zaman@prothomalo.com