পাকিস্তানে এবারের নির্বাচনের ফল ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভের প্রতিফলন
পাকিস্তানে এবারের নির্বাচনের ফল ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভের প্রতিফলন

সামরিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত

পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারি ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এই ভোটের যে ফল দাঁড়িয়েছে, তাতে দেশটির পার্লামেন্ট ঝুলন্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে। দুটি বড় রাজনৈতিক পরিবারের নেতৃত্বাধীন দুটি দল জোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, যারা মূলত সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট। 

সরকার সমর্থিত দলগুলো শেষ পর্যন্ত যদি সরকার গঠন করেও, এই ভোটের ফল সামরিক বাহিনীর জন্য পরাজয় দেখিয়ে দিচ্ছে। কারণ, টানা দুই বছর ধরে সেনা প্রতিষ্ঠান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের তেহরিক-ই- ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর ধরপাকড় চালানোর এবং ইমরানবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়ার পরও পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বাকি সব দলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। এটি ইমরান খানের জনপ্রিয় আবেদনকে সামনে তুলে ধরছে।

ভোটে দাঁড়ানোর প্রাক্কালে পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীরা জেল জুলুম, হয়রানি এবং ব্যবসাপাতিতে বাধার সম্মুখীন হন। এমনকি নির্বাচনের দিন ভোটার উপস্থিতি বাধাগ্রস্ত করার জন্য মোবাইলের নেটওয়ার্ক সার্ভিস বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এত বাধাবিপত্তির পরও পাকিস্তানি ভোটাররা সামরিক গোষ্ঠীকে ব্যালটের মাধ্যমে নজিরবিহীন ধাক্কা দিয়েছে। আদতে পাকিস্তানে নির্বাচনকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতা হিসেবে যতটা না দেখা হয়, তার চেয়ে নির্বাচনকে অনেক বেশি সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতাকারীদের এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত সুবিধা অর্জনের জন্য সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করা লোকদের মধ্যকার একটি সংঘর্ষ হিসেবে দেখা হয়।

পাকিস্তানের নির্বাচনী ফল যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির করছে, সেটি হলো কেন সরকার এত ব্যাপক জনবিরোধিতার সম্মুখীন হলো? বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে সামরিক সমর্থন পাওয়া দুর্গ হিসেবে বিবেচিত অঞ্চলগুলোতেও কেন মানুষ সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেল?

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পাকিস্তানের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান খানের জনপ্রিয়তার আবেদন এবং সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বকে তাঁর চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া পিটিআইয়ের এই বিপুল শক্তি প্রদর্শনের পেছনে আংশিকভাবে কাজ করেছে। অবাধ্যতার কারণে ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ওই মামলায় তিনি এখন ১০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।

তবে ইমরানের দলের নেতারা এত সংখ্যক আসন পাওয়ার পেছনে আরও যে বিষয়টি মুখ্যত কাজ করেছে, সেটি হলো সেনা গোষ্ঠীর প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষোভ। কারণ ২০ বছর ধরে পাকিস্তানে দ্রুতগতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও এই শ্রেণির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ক্রমাগতভাবে কমছে।

পাকিস্তানের অর্থনীতি যখন স্থবির হয়ে রয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি প্রায় ৩০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে, ঠিক সেই সময়ে গ্যালাপ জরিপ প্রতিষ্ঠান জানাচ্ছে, পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে হতাশা ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তাদের জরিপের ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক অবস্থায় রয়েছে। ব্যাপক অর্থনৈতিক অসন্তোষ সামরিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিক্রিয়াকে ইন্ধন জোগাতে সহায়তা করেছে। তবে ওই জরিপ বলছে, রাজনৈতিক দমনপীড়নের কারণেও মধ্যবিত্ত শ্রেণি সেনা–সমর্থিতদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে।

যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি একসময় ভোট দিতে যাওয়ার বদলে নাটক–থিয়েটার দেখাকে বেশি প্রাধান্য দিত, পিটিআইয়ের মেরুদণ্ডের জোর দেখে তারাও এবার ভোট দিতে যাওয়ায় আগ্রহী হয়েছে। ইমরান খানের মধ্যবিত্ত সমর্থকদের ওপর সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন বেড়ে যাওয়ায় এই শ্রেণি এবার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি খেপে গেছে। নারী সমর্থকদের মধ্যেও প্রবল সেনাবিরোধিতা দেখা গেছে। মূলত পাকিস্তানের প্রযুক্তি সচেতন যুব সম্প্রদায়ের কারণে এই সামরিকবিরোধী জনমানুষ তৈরি হয়েছে।

ইউএনডিপির হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানের এখন দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ রয়েছে। নতুন ভোটারদের একটি বিশাল সংখ্যা সামরিক বাহিনীর প্রতি অসহানুভূতিশীল। পাশাপাশি দেশটিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৩০ লাখ। এদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। এই নতুন ভোটারদের কাছে সামরিক গোষ্ঠীর পক্ষের ভাষ্যকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এবারের নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতির পেছনে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় ধরনের ভূমিকা ছিল।

সেনাসম্পর্কিত সরকার দমনপীড়নের মাধ্যমে স্থিতিশীল অবস্থা ধরে রাখতে চাওয়ায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার ঐতিহাসিক ক্ষতি হয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতা মধ্যবিত্তের অভিযোগগুলোকে অনিষ্পন্ন অবস্থায় রেখেছে। এটি পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আদিল মালিক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত