রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: ওদের বিচার করবে কারা

নিজ কক্ষে মোবাইল সার্ভিসিং করে উপার্জিত টাকায় চলে সামসুল ও তার ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা এবং সংসারের কিছু টুকিটাকি খরচও
ছবি : প্রথম আলো

দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি। সুদীর্ঘ এ শিক্ষকতাজীবনে কখনো নিজেকে এতটা অসহায় ভাবিনি, এতটা নিরুপায় মনে হয়নি। কোনো একজন শিক্ষার্থীর জন্য এতটা বেদনা অনুভব করিনি। আমি একজন নিপীড়িত অসহায় শিক্ষার্থী সামসুল ইসলামের অভাগা শিক্ষক। সামসুল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

১৯ আগস্ট তাঁর নিজ আবাসিক হলে ছাত্ররূপী একদল মাস্তানের নির্যাতনের শিকার হয়ে সে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হলেও সে সাহস হারায়নি। ভয়কে জয় করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সে লিখিত অভিযোগ করেছে। তার অভিযোগ, মতিহার হলের ছাত্রলীগের নেতা চাঁদা না পেয়ে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে তিন ঘণ্টা ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে এবং তার কাছে থাকা অর্থ জোর করে কেড়ে নিয়েছে।

নিজ কক্ষে মোবাইল সার্ভিসিং করে উপার্জিত টাকায় চলে সামসুল ও তার ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা এবং সংসারের কিছু টুকিটাকি খরচও। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র উপার্জনে তাদের ছয় সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। বড় ছেলে সামসুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো পরিবারটির জন্য দিবাস্বপ্ন।

কিন্তু সামসুল হাল ছাড়েনি। নিজের উপার্জিত অর্থে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। করোনার সময় টিউশনি বন্ধ হয়ে গেলে ঘরে বসেই সে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখেছে। হলজুড়ে তার এ কাজের খ্যাতি ছড়িয়েছে। এ খ্যাতিই হয়েছে তার বিড়ম্বনা। তার এ উপার্জনের প্রতি কুনজর পড়ে এক নিপীড়কের। গত শুক্রবার বিকেলে তুলে এনে তার ওপর চালানো হলো অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।

ঘটনার দিন ছাত্র-উপদেষ্টার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে তার সঙ্গে ঘটা বিভীষিকাময় নির্যাতনের বর্ণনা দিতে দিতে সে বারবার থেমে যাচ্ছিল, ভয়ে আঁতকে উঠছিল, তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমারই এক ছাত্রের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হলো। রাজশাহীর বাইরে থাকায় সেদিন ওর পাশে দাঁড়াতে পারিনি। ঘটনার দুদিন পর সামসুলের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তখনো তার চেহারায় ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। কপালে ক্ষতচিহ্ন। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। থেমে থেমে কথা বলছে। মাঝেমধ্যে আঁতকে উঠছে। বাঁ কানে ভালো শুনছে না। রাতে ঘুমাতে পারছে না। টিকটিকির শব্দেও প্রাণ চমকে যাচ্ছে, পাশের কক্ষের দরজার কড়া নাড়ানোর শব্দেও আতঙ্কে তার বুক কেঁপে যাচ্ছে। এই বুঝি ওরা আবার তাকে তুলে নিয়ে যাবে।

লেজুড়বৃত্তিক তোষণের রাজনীতি নষ্ট করেছে যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা; ম্লান করেছে আমাদের নৈতিকতা, সততা আর বিবেকবোধকে। এ রকম বাস্তবতায় আমার সন্তানের প্রশ্ন, ‘বাবা, ওদের বিচার হবে না?’ প্রশ্নের জবাবে, ‘বাবা, ওদের বিচার করবে কারা?’ এ ছাড়া আর কী বলার আছে।

সামসুলের এ অসহায় আর ভয়ার্ত চেহারা, তার নিরাপত্তাহীন চাহনি হতবিহ্বল মুখচ্ছবি আমার মনটাকে একেবারে দুমড়েমুচড়ে দিল। নিজেকে ভীষণ অপরাধী আর অসহায় মনে হলো একজন শিক্ষক হিসেবে, এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে। একজন ছাত্রের এই চরম বিপদে আমি তার জন্য কিছুই করতে পারছি না। যারা তাকে মেরে রক্তাক্ত করল, টাকা ছিনিয়ে নিল, কাউকে বললে বুয়েটের আবরার ফাহাদের পরিণতি বরণ করতে হবে বলে শাসাল, সেই নির্যাতনকারীদের মাঝেই তাকে হলে ফিরতে হলো চরম উৎকণ্ঠা আর অনিরাপত্তার মানসিক চাপ নিয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা হল প্রশাসন তাকে অন্তত প্রথম কয়েক রাতের জন্য পুলিশ প্রটেকশন দিতে পারত। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো, ভোর না হতেই অভিযুক্ত নেতার সংগঠনের বড় নেতারা এসে সামসুলকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাফ চেয়ে তথাকথিত মীমাংসা করে ফেলল।

যে ছেলেটি সারা রাত ঘুমাতে পারেনি, দরজায় একটু কড়া নাড়ার শব্দে যার বুকের হৃৎস্পন্দন রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে, তার কক্ষে অভিযুক্ত ছাত্রের সংগঠনের বড় বড় নেতা মিটমাট করতে আসার অর্থ হচ্ছে আরেকটি মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি করা। সামসুলের এখন কোনো অভিযোগ নেই। সে রাতে তার দেওয়া লিখিত অভিযোগ সে তুলে নেবে। সে তার প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তার বিভাগের শিক্ষার্থীদের বারবার নিষেধ করেছে। এভাবেই একজন সাহসী ও সংগ্রামী সামসুলের অসহায় আত্মসমর্পণ হলো।

আর আমরা সাধারণ শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্যারিস রোডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটু মানববন্ধন, একটু প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে! এ দেশ, এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবেই নিপীড়কদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকবে। এভাবেই সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে।

এ যেন অপরাধ করার ক্ষমতা যার, মিটমাট করার অধিকার তার। এভাবে সামসুলরা বারবার মার খাবে আর তথাকথিত মিটমাট করতে বাধ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্র, দেশের নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী তাদের কি কোনো দায় নেই! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ যেন ইট-পাথরের জঙ্গল। এখানে জোর যার মুল্লুক তার। মানবিক মূল্যবোধ, আদর্শ, নীতিনৈতিকতা—সব মূল্যহীন। এ জঙ্গলে সত্যিই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

সামসুলের এই তথাকথিত মিটমাটে তার মনঃকষ্ট আরও বেড়েছে। একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছে। তার পাশে যে বন্ধু-সহপাঠীরা দাঁড়িয়েছিল, সামসুলের এই এক রাতে উল্টে যাওয়া তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

কিন্তু কী যন্ত্রণায়, কী মানসিক চাপ তৈরি হলে এ রকম একটি সাহসিকতার মৃত্যু হয়, সেটা ভুক্তভোগী না হলে হয়তো কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। ক্ষমতাসীন দলের অতি ক্ষমতাধর ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে সে কার্যত একা ও চরম অনিরাপদ। এ রকম অরক্ষিত অবস্থায় বেশি সময় কারও পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার পাশে দাঁড়ায়নি, তাকে সাহস জোগায়নি, নিরাপত্তা দেয়নি।

সামসুলকে বোঝালাম, ‘তুমি এটা নিয়ে ভেবো না, মন খারাপ কোরো না, তোমার অবস্থান থেকে তুমি ঠিক করেছ। তোমার জীবন, তোমার লেখাপড়া, তোমার নিরাপত্তা সবার আগে।’ যে সমাজে বিচারহীনতা মহামারির আকার ধারণ করেছে, যে সমাজে বিচার চেয়ে আদালতে আদালতে ঘুরতে হয়, যে সমাজে পুলিশ মামলা পর্যন্ত নিতে চায় না, সে দেশে অপরাধীর সঙ্গে মিটমাট না করে কীই-বা করার আছে।

যাদের কাছে সে বিচার চাইবে, যাদের ক্ষমতা আছে এই অন্যায়ের বিচার করার, সেই নিপীড়কেরা তাদের কাছে ‘ওরা তো আমাদেরই ছেলে’ এই শ্রেণিভুক্ত!

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতি এ সমাজকে কী দিয়েছে জানি না, তবে ম্লান করেছে অনেক কিছু।

লেজুড়বৃত্তিক তোষণের রাজনীতি নষ্ট করেছে যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ, শিক্ষাঙ্গনে সুশাসন প্রতিষ্ঠা; ম্লান করেছে আমাদের নৈতিকতা, সততা আর বিবেকবোধকে। এ রকম বাস্তবতায় আমার সন্তানের প্রশ্ন, ‘বাবা, ওদের বিচার হবে না?’ প্রশ্নের জবাবে, ‘বাবা, ওদের বিচার করবে কারা?’ এ ছাড়া আর কী বলার আছে।

  • ড. ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

faridecoru@yahoo.co.uk