ভবিষ্যদ্বাণী করা সব সময়ই কঠিন। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তা আরও কঠিন। কারণ, তিনি এলোমেলো কথা বলেন। তিনি বারবার অবস্থান বদল করেন। আর মনে করেন, খামখেয়ালিপনা আচরণ করা দর-কষাকষির জন্য ভালো কৌশল। তবে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার বক্তব্য, তাঁর নিয়োগ করা ব্যক্তিদের পরিচয় আর প্রথম মেয়াদের কর্মকাণ্ড দেখে কিছুটা ধারণা করা যায়।
চীন প্রসঙ্গে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, তা নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে কী দেখব? আমরা দেখতে পাচ্ছি, ট্রাম্পের সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মার্কো রুবিও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে মাইকেল ওয়াল্টজকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা দুজনেই চীনকে বড় হুমকি মনে করেন এবং দুজনেই চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার পক্ষপাতী। ট্রাম্প নিজেও প্রচারে বলেছেন, তিনি মিত্রদের থেকে আমদানিতে নতুন শুল্ক আরোপ করবেন, আর চীনের পণ্যের ওপর আরও বেশি শুল্ক বসাবেন।
ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরোনো ধারা অনুসরণ করতে চান। প্রথম উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আমেরিকার স্বার্থ থাকবে সবার আগে…আমরা কাউকে আমাদের মতো হতে বাধ্য করব না; বরং আমাদের জীবনধারাকে সবার জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে প্রদর্শন করব।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বার্তা দেয় না; তবে এটি পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর নীতির দিকেও যায় না।
ইতিমধ্যে ট্রাম্প মেক্সিকো, কানাডা আর চীন থেকে আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের কথা ঘোষণা করেছেন। তাই কিছু শুল্ক বাড়বে, সেটি নিশ্চিত। তবে শুল্কের হার কী পরিমাণ বাড়বে, কত দিন সেই শুল্ক বহাল থাকবে, কী কী পণ্যে সেই শুল্ক প্রভাব ফেলবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
এর পেছনে দেশীয় রাজনীতি আর ট্রাম্পের ইচ্ছা কাজ করবে। তাঁর মনোনীত অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাম্প উত্তেজনা তৈরি করে, তা কমানোর কৌশল নেন। আমার লক্ষ্য হবে তাঁর প্রশাসনের হয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রক্ষা করা।’ মার্কিন বাণিজ্য অংশীদারেরা যদি পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, ট্রাম্প তখন কী করবেন, তা স্পষ্ট নয়। যদি এই পাল্টাপাল্টি বাণিজ্যযুদ্ধ শুল্ক আর পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে। এটি জনগণের ক্ষোভ বাড়াবে।
দর-কষাকষিতে দক্ষতার দাবি করা ট্রাম্প হয়তো কিছু সমঝোতা করতে চাইবেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে এমন একটি চুক্তি করতে পারেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রতি সমর্থন কিছুটা কমাবে। আর এর বদলে একটি বাণিজ্য চুক্তি করবে এবং সেই চুক্তিকে তিনি তাঁর সাফল্য হিসেবে দেখাবেন। এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মিত্রদেশ এমন পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।
ট্রাম্পের প্রচার এবং আগের মেয়াদ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি আন্তর্জাতিক চুক্তি আর মৈত্রীর ওপর কম গুরুত্ব দেবেন। তিনি আবার প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে চান এবং তেল ও গ্যাসের উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াতে চান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম কমছে, তবে তাঁর নীতির কারণে এসব শিল্প প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প সব সময়ই ইসরায়েলকে সমর্থন করেছেন। ইসরায়েলের সঙ্গে চারটি আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল যে আব্রাহাম চুক্তি, সেই চুক্তি তিনিই ঠিক করে গিয়েছিলেন এবং তা নিয়ে তিনি বরাবরই গৌরববোধ করে আসছেন।
বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল; কিন্তু সৌদি আরব শর্ত দিয়েছিল, ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের পথে পদক্ষেপ নিতে হবে; কিন্তু ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকার দুই–রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধী। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের জনগণও এই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। ট্রাম্প হয়তো এই অঞ্চলে তাঁর আগের সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিতে চাইবেন; কিন্তু তিনি কীভাবে তা করবেন, তা বোঝা কঠিন।
ইউরোপ আর ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ‘এক দিনে’ ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। তিনি কীভাবে যুদ্ধবিরতি আনবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। এমন হতে পারে, ট্রাম্প ইউক্রেনকে কম সহায়তা দিয়ে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবেন, যাতে ইউক্রেন রাশিয়ার শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আবার তিনি এমন সমাধানের দিকেও যেতে পারেন, যাকে ‘কোরিয়ান সমাধান’ বলা হয়। এই সমাধানে, যুদ্ধক্ষেত্রের বর্তমান সীমান্তকে নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল বানানো হবে, যেখানে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় শান্তিরক্ষীরা অবস্থান করবে।
ট্রাম্পের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরোনো ধারা অনুসরণ করতে চান। প্রথম উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আমেরিকার স্বার্থ থাকবে সবার আগে…আমরা কাউকে আমাদের মতো হতে বাধ্য করব না; বরং আমাদের জীবনধারাকে সবার জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে প্রদর্শন করব।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বার্তা দেয় না; তবে এটি পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানোর নীতির দিকেও যায় না।
● জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ