বাবরি মসজিদ সরিয়ে রামচন্দ্রের মন্দির বানানো বা জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের যে প্রতিশ্রুতি ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ১৯৮০ সালে দল গঠনের পর থেকে নির্বাচনী ইশতেহারে দিয়ে আসছিল, তা তিন বছর আগেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
এসবের বাইরে, সংখ্যালঘু প্রশ্নে, ভারতের সংবিধান নির্দেশিত একমাত্র অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউনিফর্ম সিভিল কোড) বা সব নাগরিকের জন্য এক আইনের প্রতিশ্রুতি একমাত্র এখনো পূর্ণ করেনি বিজেপি। ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব আইনও প্রযোজ্য, তাই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে।
অর্থাৎ তিনটি প্রধান সংখ্যালঘুবিষয়ক প্রতিশ্রুতির মধ্যে দুটি পূর্ণ করেছে, একটি অপূর্ণ রয়েছে। এটি বিজেপি ২০২৪–এর লোকসভা নির্বাচনের আগে করার চেষ্টা করবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। এখন বিজেপির নতুন মুসলমান সমীকরণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। প্রধানত, এই নয়া মুসলমান ফর্মুলার দুটি দিক আছে, একটি ট্র্যাডিশনাল অর্থাৎ যেটা চলে আসছে।
এটা হলো, নানাভাবে ভারতের সংখ্যালঘু সমাজকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা, যাতে মনে হয় তারা সারাক্ষণ ভারতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানত, মুসলমান সমাজকে অন্য পক্ষ বা শত্রুপক্ষে রূপান্তরিত করাই এর লক্ষ্য। দ্বিতীয় দিকটি সম্পূর্ণ নতুন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেওয়া এ ফর্মুলা ব্যাখ্যা করতে সৈয়দ মুজতবা আলীর বহুপঠিত ভ্রমণোপন্যাস দেশে-বিদেশে-এ দ্বারস্থ হই।
আফগানিস্তানে শিক্ষকতার সময়ে মুজতবা আলীর এক চাষা বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সেই বন্ধুত্ব বেশি দিন না টেকার কারণ হিসেবে মুজতবা আলী লিখছেন, ‘আমাদের দিলখোলা বন্ধুত্ব প্রায় লোপ পাওয়ার মতো অবস্থা হলো যেদিন সে শুনতে পেল আমি ‘সৈয়দ’।’ অর্থাৎ আলী একজন উঁচু জাতের মুসলমান এবং তাঁর ‘চাষা বন্ধু’ নিচু জাতের। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে মুসলমান সমাজের একাংশ বলেছেন, ইসলামের মধ্যে জাতপাত নেই। কিন্তু ভারতের মুসলমান সমাজ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তঁাদের বড় অংশই এখন মনে করেন, ভারতে মুসলমান সমাজেও জাতপাতকেন্দ্রিক বৈষম্য রয়েছে, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যও তৈরি করেছে।
ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিষ্কের নরেন্দ্র মোদি বিষয়টি লক্ষ করেছেন। গত জুলাই মাসের গোড়ায় বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে মোদি বলেন, দলকে ‘সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা সংখ্যালঘুদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে হবে।’ মুসলমান প্রশ্নে বিজেপির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিচ্ছে, অনেক পরিকল্পনার পরেই এই মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ মামলাগুলোর অন্যতম প্রধান স্থপতি আইনজীবী বিষ্ণুশংকর জৈন এই লেখককে ২০২১ সালে বলেছিলেন, সারা ভারতে অন্তত ৫০টি মসজিদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যা স্থানান্তরিত করা হবে ’৯১-এর আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে। ‘হিন্দু পুণ্যার্থীরা যদি আদালত থেকে বিচার না পান, তবে তাঁরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না,’ বলেছিলেন জৈন।
যেমন বছরের গোড়ায় নির্বাচনে জেতার পরে দানিশ আজাদ আনসারি নামের এক নেতাকে উত্তর প্রদেশে সংখ্যালঘু কল্যাণ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী করেন যোগী আদিত্যনাথ। যে রাজ্যে দিনের পর দিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কোণঠাসা এবং মুসলমান প্রার্থীদের লোকসভা বা বিধানসভায় কোনো স্থান নেই, সেখানে মন্ত্রিসভায় একজন মুসলমানকে নিয়ে আসার কারণ কী?
দানিশ আনসারি উত্তর প্রদেশ এবং ভারতের সেই অংশের মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করেন, যঁারা মুজতবা আলীর ‘চাষা বন্ধু’। অর্থাৎ যাঁদের ভারতে নিচু জাতের বলে গণ্য করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যেমন ব্রাহ্মণ এবং দলিত, তেমনি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সৈয়দ এবং চাষা বন্ধু অর্থাৎ পশমন্দা। সৈয়দদের সঙ্গে মধ্য এশিয়া থেকে আগত মোগল, পাঠান ও শেখদেরও এই গোত্রের মধ্যে রাখা হয়।
ভারতের কিছু কিছু সম্প্রদায় যাঁরা উচ্চবর্ণের মধ্যে ছিলেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন, তঁাদেরও উচ্চবর্ণের মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু ভারতের মোটামুটিভাবে ২০ কোটি মুসলমানের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হলেন এই উচ্চবংশীয়রা। এদের বলা হয় আশরাফ।
অন্যদিকে রয়েছে আজলাফ (পশ্চাৎপদ) এবং আর্জাল (দলিত) সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমান যাদের মিলিতভাবে বলা হয় পশমন্দা। গবেষকদের মতে, এদের সংখ্যা ৮০-৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ, বড় অংশই পশমন্দা মুসলমান। দানিশ আনসারি একজন পশমন্দা।
এবার আগামী লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যাক। ভারতে ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১০১টিতে মুসলমান ভোট ২০ শতাংশের ওপরে। এই আসনে বিরোধীদের সার্বিক প্রাধান্যের অন্যতম কারণ মুসলমান ভোট একত্র হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে যাওয়া।
২০২৪ সালে লোকসভা ভোট যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকলেও মোদির জন্য এ নির্বাচন অতটা সহজ হবে না। এ অবস্থায় ১৫-২০টি আসনও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে পশমন্দা ভোটের কিছুটা টানতে পারলে বিজেপির সুবিধা। ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের ভোট যদি ভাঙা যায়, তবে ভবিষ্যতে এ অংশ থেকে আর কোনো প্রতিরোধ আসবে না, যেমনটা এসেছিল নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের সময়ে।
ভারতের হিন্দু ধর্মনিরপেক্ষ দল ও ব্যক্তির প্রধান শক্তি চরম দারিদ্র্য, নিপীড়িত মুসলমান। তার পেছনে দাঁড়িয়ে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ধর্মনিরপেক্ষ দল ও ব্যক্তিরা। এই শক্তিকে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু জাতের মধ্যে বিভাজিত করা গেলে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ আর বিজেপির থাকে না।
এ জন্যই গত আগস্ট মাসে ভারতের তিনটি প্রধান সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং জামিয়া হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশ পশমন্দা সংরক্ষণ চেয়েছেন বিজেপির ওবিসি সংগঠনের জাতীয় সভাপতি কে লক্ষণ।
অর্থাৎ আগামী দিনে শিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের সংরক্ষণের দাবি তুলবে এমন একটি দল, যারা মুসলমানবিরোধিতার রাজনীতির মধ্যে দিয়ে ভারতে ক্ষমতায় এসেছে এবং এখনো আছে।
মুসলমান সমাজের অনেকে আবার বিজেপির সাম্প্রতিক মুসলমান রাজনীতিতে অখুশি নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিমবঙ্গের এক মুসলমান সমাজকর্মীর ভাষ্য, মুসলমান সমাজের একটা অংশের, বিশেষ করে প্রভাবশালী পরিবার এবং ধর্মগুরুদের অত্যাচারে পিছিয়ে পড়া মুসলমানরা জর্জরিত।
তিনি বলেন, ‘এদের কথা ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো বলবে না, কারণ তাদের ভয় মওলানা, ইমাম ইত্যাদি মাতবর এবং প্রভাবশালী আশরাফেরা সঙ্গে না থাকলে মুসলমানগরিষ্ঠ আসন জেতা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, বিজেপির বলার প্রশ্নই ওঠে না। এ অবস্থায় নরেন্দ্র মোদি নতুন কোনো ফর্মুলা দিলে পশমন্দারা অবশ্যই তা ভেবে দেখবেন।’
ভারতের পশমন্দা সমাজের প্রধান সংগঠনগুলো এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। কংগ্রেস, বামপন্থীসহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দল এ অবস্থায় আগামী দিনে মুসলমান ভোট ধরে রাখতে পারবে কি না, বলা কঠিন।
তবে বিজেপির একটা ঝুঁকিও আছে। সেটি হলো ফর্মুলার প্রথম দিক। ঝুঁকিটা হলো কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে। তাঁরা বিজেপিকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন মুসলমানবিরোধী রাজনীতির কারণে।
তাঁরা মুসলমান সংরক্ষণের রাজনীতি মেনে নিতে পারবেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। হয়তো সেই কারণেই ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিও অবলম্বন করেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব, যাতে প্রধান সমর্থকেরা দূরে সরে না যান। এ ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি হলো কট্টর মুসলমানবিরোধিতা। এ বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে আসামে। গত সাত মাসে চল্লিশের বেশি ব্যক্তিকে আল-কায়েদার বাংলাদেশি শাখা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মনে রাখা প্রয়োজন, এদের প্রত্যেককে গ্রেপ্তার এবং প্রচারমাধ্যমে জনমত তৈরি করা হয়েছে বিজেপিশাসিত আসাম সরকার বা প্রশাসন বক্তব্যের ভিত্তিতে। পাশাপাশি আসামে সরকারি-বেসরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কয়েকটি মাদ্রাসা ভাঙা হয়েছে এবং তুলে দেওয়া হয়েছে। উত্তর প্রদেশের মাদ্রাসায় সমীক্ষা চালানোর কথা ঘোষণা করেছে সে রাজ্যের সরকার, বিহারেও একই দাবি তুলেছে বিরোধী দল বিজেপি।
এ ছাড়া উত্তর প্রদেশসহ ভারতের আরও একাধিক স্থানে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বেশ কিছু মসজিদের তলায় মন্দির আছে দাবি করে মামলা করেছে। এদের মূল লক্ষ্য হলো, ভারতে ধর্মীয় স্থানের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আইন প্লেসেস অব ওয়ার্শিপ অ্যাক্ট (১৯৯১) পরিবর্তন করা।
এ মামলাগুলোর অন্যতম প্রধান স্থপতি আইনজীবী বিষ্ণুশংকর জৈন এই লেখককে ২০২১ সালে বলেছিলেন, সারা ভারতে অন্তত ৫০টি মসজিদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যা স্থানান্তরিত করা হবে ’৯১-এর আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে। ‘হিন্দু পুণ্যার্থীরা যদি আদালত থেকে বিচার না পান, তবে তাঁরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না,’ বলেছিলেন জৈন।
আইনি প্রক্রিয়াকে লোকসভা নির্বাচনের আগে আদালতের বাইরে গণ-আন্দোলনে পরিণত করা বিজেপির লক্ষ্য হবে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
এ দ্বিস্তরীয় ফর্মুলায় মুসলমান সমাজ, তার প্রতিরোধ এবং ভোটব্যাংককে ভাঙার চেষ্টা আপাতত ভারতে শুরু হয়েছে।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা