চলতি মাসের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একটি প্রশ্নপত্র নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম হয়। ওই বিভাগের একটি কোর্সের মিডটার্ম পরীক্ষার প্রশ্নে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের হত্যাকাণ্ড ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি প্রসঙ্গ উঠে আসে।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় থাকা এ দুটি ঘটনা দুটি আলাদা প্রশ্নে তুলে ধরে মার্ক্স, ফ্রয়েডসহ বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ করতে বলা হয়। প্রশ্নপত্রটি ব্যতিক্রম হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে খবর হয়।
প্রশ্নকর্তা বিশেষভাবে প্রশংসিত হন তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য। কেননা, প্রশ্নে ব্যবহৃত ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাকাঠামোর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ওই অধ্যাপক জানান, এ ধরনের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তিনি এর আগেও করেছেন। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান তত্ত্ব দিয়েই পরিবর্তনশীল সমাজকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ প্রশ্নের সূত্র ধরে নতুন করে কথা উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগে বছরের পর বছর কেন একই ধরনের প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় গতানুগতিক ধারার প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন সমন্বয়ের কাজ করতে গিয়ে সেটা লক্ষ করেছি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শিক্ষার্থীরা দু-চার বছরের প্রশ্ন দেখে নিজেরাই ‘শর্ট সাজেশন’ তৈরি করে নিতে পারেন। এর মধ্যে আবার ঠিক আগের বছরের প্রশ্নগুলো একেবারে বাদ দেওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন, সীমিতসংখ্যক প্রশ্নের প্রস্তুতি নিয়েই পরীক্ষায় ভালো করা সম্ভব। কোর্স শিক্ষক শ্রেণিতে কী পড়াচ্ছেন বা কীভাবে পড়াচ্ছেন, তা অনুসরণ না করলেও চলে।
শ্রেণিতে উপস্থিতির ওপর নম্বর বরাদ্দ থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রায় নিয়মিতই ক্লাস করেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। পাঁচ-সাতজন ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণিতে মনোযোগী থাকেন না। তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের অভিমত, ক্লাসে অনেক শিক্ষকের আলোচনা বা লেকচার উপভোগ্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ গুণগত মান উন্নয়ন (আইকিউএসি) নিয়ে কাজ করার সময়ে খেয়াল করেছি, অধিকাংশ শিক্ষক তাঁদের শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করেন না। একমুখী লেকচারের বাইরে পাঠদানের যে বহু বিকল্প উপায় রয়েছে, সেটি তাঁদের জানা নেই কিংবা জানলেও ব্যবহার করেন না।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষাদানের পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই পরিবর্তনের ব্যাপারটি বিশেষভাবে ধরা পড়ে না। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় যা লেখেন, সেসবের কতটুকু বুঝে লেখেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে দেখেছি, শিক্ষার্থীরা তাঁদের লিখিত প্রশ্নের বিষয় নিয়েও কথা বলতে পারেন না।
অন্য ধরনের সমস্যা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে ক্লাসরুম সংকট রয়েছে। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার জন্য পর্যাপ্ত আসন নেই, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা নেই, এমনকি নেই লেখার উপযোগী বোর্ডও। শ্রেণিকক্ষগুলোয় লেকচার দেওয়ার সময় জনসভায় ভাষণ দেওয়ার মতো করে চিৎকার করতে হয়।
শিক্ষার্থীদের সামনে এনে কোনো কিছু উপস্থাপন করতে দিলে পেছনের শিক্ষার্থীরা তা দেখতে বা শুনতে পান না। বিভাগের সেমিনার পাঠকক্ষেও নতুন প্রকাশিত বই পাওয়া যায় না। পুরোনো বইয়েরও ঘাটতি রয়েছে সেখানে।
শিক্ষার্থীদের অবশ্য এ জন্য খুব একটা সমস্যাও হয় না। কারণ তাঁরা জানেন, পরীক্ষার জন্য কোন প্রশ্ন পড়তে হবে। সেগুলোর জন্য পরীক্ষার আগে বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে নোট নিয়ে ফটোকপি করে মুখস্থ করলেই চলে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বলতে এখন বোঝায় বিসিএস পরীক্ষার জন্য গাইড মুখস্থ করা।
শিক্ষার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারেন, এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নানা রকম চিন্তা করে! শিক্ষাদান ও প্রশ্নপদ্ধতির গতানুগতিক ধারা শিক্ষার্থীদের বিষয়গত ধারণায় দুর্বল করে রাখছে।
এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সবার আগে দরকার প্রশ্নে বদল আনা। প্রশ্নে অভিনব ও বৈচিত্র্যময় ধারা তৈরি করতে পারলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হবেন একাডেমিক পড়াশোনায় মনোযোগী হতে। একই সঙ্গে শিক্ষকের দায়িত্ব লেকচারকে অধিক আকর্ষণীয় ও কার্যকরভাবে উপস্থাপন করা।
তা ছাড়া একমুখী লেকচারের বদলে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি উপস্থাপনার সুযোগ করে দিতে হবে। তাঁদের দলে ভাগ করে কিংবা এককভাবে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ওয়ার্ক দিতে হবে, যুক্ত করতে হবে ছোট ছোট গবেষণাকাজে। কাজগুলোও এমন হবে, যাতে পরিবর্তনশীল সমাজ ও জীবনকে তাঁরা বিষয়গত ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষাদানের পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই পরিবর্তনের ব্যাপারটি বিশেষভাবে ধরা পড়ে না। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় যা লেখেন, সেসবের কতটুকু বুঝে লেখেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে দেখেছি, শিক্ষার্থীরা তাঁদের লিখিত প্রশ্নের বিষয় নিয়েও কথা বলতে পারেন না।
আরও সমস্যা আছে, প্রতিটি বিভাগের সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম আছে, কিন্তু কোনো কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম নেই। পাঠ্যক্রম তৈরির আগে যে শিক্ষাক্রম থাকা দরকার, এটা বিভাগগুলো মনেই করে না। অথচ আগে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা দরকার ছিল।
সেই শিক্ষাক্রমে নির্ধারণ করা থাকবে শিক্ষার্থী তাঁর বিষয়ে কোন কোন দক্ষতা বা যোগ্যতা অর্জন করবে। এই লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে একেকটি কোর্সের কাঠামো তৈরি করতে হবে। লক্ষ্য ঠিক করা সম্ভব হলে প্রশ্নপত্র তৈরির কাজটিও শিক্ষকদের জন্য সহজ হয়ে যেত।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক