ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে কারণে আরব নেতাদের এই বিশ্বাসঘাতকতা

গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে আরব দেশগুলোতে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে
ছবি: রয়টার্স

শুধু মুখের বুলি যথেষ্ট নয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব যথেষ্ট নয়। আনুষ্ঠানিক নিন্দা যথেষ্ট নয়। সামান্য পরিমাণ ত্রাণ পাঠানো যথেষ্ট নয়। এসব কথা ও কাজের সবই ফাঁকা ও অর্থহীন।

ফিলিস্তিনে যখন গণহত্যা চালানো হচ্ছে, ইসরায়েল যখন কারও কথায় পাত্তা না দিয়ে নির্বিচার শহরগুলো ধ্বংস করছে, তখন আরব দেশগুলোকে অর্থপূর্ণভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ইসরায়েল যখন দানবের মতো মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে, তখন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষসহ পুরো আরব বিশ্বকে কুণ্ঠাহীনভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আরব বিশ্বের সব দেশ শুধু নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ মাথায় রেখে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কোনোভাবেই তারা নৈতিক অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না। আমি সব সময়ই ন্যায্যতার ভিত্তিতে অবস্থান নেওয়ার পক্ষে থাকায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই অবস্থানে থেকেই আমি মনে করছি, আরব দেশগুলোকে নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই ইসরায়েলের সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব সব সম্পর্ক ছিন্ন করা দরকার।

ইসরায়েল যেখানে তার ঔপনিবেশিক প্রকল্প এগিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে, সেখানে আরব শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থের বাইরে কিছু ভাবতে পারছে না এবং ফিলিস্তিনিদের বিষয়কে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। আরব দেশগুলোর এই উন্নাসিকতার দুটি কারণ রয়েছে।

এর মধ্যে প্রাথমিক ও প্রধান কারণ, আরব নেতারা ইসরায়েলের সামরিক ক্ষমতাকে ভয় পান; বিশেষ করে ইসরায়েল কার্যত একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ায় তাঁদের ভয়টা বেশি। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ালে তা আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষা করবে, এমনটি আরব নেতারা বিশ্বাস করেন না। উল্টো তাঁরা বিশ্বাস করেন, ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে সেটি আরব সেনাবাহিনীগুলোকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।

দ্বিতীয় কারণ হলো, এই শাসকেরা কোনোভাবেই পশ্চিমা শক্তিগুলোকে খেপিয়ে তুলতে চান না। এই শাসকেরা ভালো করেই বুঝতে পারেন, ইসরায়েল পশ্চিমাদের একটি সাম্রাজ্যবাদী সহচর। তাঁরা সব দিক হিসাব–নিকাশ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, যেহেতু তাঁরা মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেন না, যেহেতু পশ্চিমাদের তালে তাল মেলালে অনেক আর্থিক লাভ হয়, সেহেতু পশ্চিমাদের কথার বাইরে না গিয়ে চলাই সব দিক থেকে নিরাপদ।

আসল ঘটনা হলো, পশ্চিমাদের অনুগ্রহ যারা পেয়ে থাকে, তারা সংখ্যায় খুবই কম। মূলত অর্থনৈতিকভাবে অভিজাত একটি শ্রেণি এই সব সুবিধা পেয়ে থাকে। পশ্চিমা আর্থিক সুবিধার ছিটেফোঁটা হয়তো মধ্যবিত্তের কপালেও কালেভদ্রে জোটে, কিন্তু এই আরব অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ সেসব সুবিধা পায় না। ফলে যৌক্তিকভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব জনগণ ক্ষমতার কাছে থাকা অভিজাত গোষ্ঠীকে দুর্নীতিপরায়ণ মনে করে। ২০১১ সালে আরব বসন্তখ্যাত গণবিদ্রোহের মূল কারণ ছিল এটিই।

যদিও আরব শাসকদের অনেকেই প্রতিবাদকারীদের কয়েদখানায় বন্দী করে, নির্যাতন করে, হত্যা করে, নজরদারিতে নিয়ে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রেখেছেন এবং বিদ্রোহ দমন করে আসছেন; কিন্তু এসব দিয়ে তাঁরা জনগণের বিপ্লবী চেতনাকে হারিয়ে দিতে পারেননি। ফলে একটু সুযোগ পেলেই জনগণ আবার বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এবং ক্ষমতাসীনদের নামাতে রাস্তায় নেমে পড়বে।

যদিও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠী এটিকে ‘নিরাপত্তাব্যবস্থা’ প্রয়োগের মাধ্যমে সামাল দেওয়ার মতো একটি সমস্যা বলে মনে করে (যেমনটি তারা ২০১০ সালে মনে করেছিল); কিন্তু আমি বলব, এটি একেবারেই স্বল্পমেয়াদি চিন্তাভাবনা। আমি মনে করি, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা মাথায় রেখে এই জনক্ষোভ ভেতর থেকে প্রশমন করা উচিত।

আরব বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ নানা কারণে অকুণ্ঠভাবে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে। তারা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে নিজেদের মর্যাদা ও মুক্তির আন্দোলনের প্রতিফলন হিসেবে দেখে। যখন তারা আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রের মর্যাদা না পাওয়া গরিব ফিলিস্তিনিদের পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে দেখে, তখন তারা দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হয়।

ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামী চেতনা আরব জনগণের মধ্যে তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী শাসনের আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলে। তারা তখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করে, কেন মিসর ও জর্ডানের সরকার গাজার ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা অবসানে সক্রিয় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে; কেন সৌদি আরব তার তেল সরবরাহের সুবিধাকে ব্যবহার করে ইসরায়েলকে যুদ্ধে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছে না।

যদিও শাসকগোষ্ঠী তাদের জনগণকে সামষ্টিকভাবে তাদের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়; কিন্তু দিন শেষে প্রশ্নগুলো জনগণের হৃদয়ের মধ্যে আটকে থাকে। এই প্রশ্নগুলো আরব সম্প্রদায়ের তৃণমূল পর্যায়ে সার্বক্ষণিকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

তবু এই শাসকেরা এত মানুষের চাওয়ার বিপক্ষে দাঁড়ান শুধু পশ্চিমাদের স্বীকৃতি ও সহযোগিতার আশায়।

সর্বগ্রাসী শাসকেরা কখনোই তাঁদের দ্বারা শাসিত জনগণের মুখোমুখি হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। উল্টো তাদের তাঁরা ভয় পান। যদিও পশ্চিমাদের স্বীকৃতির জোরে এই শাসকেরা দীর্ঘদিন টিকে আছেন, কিন্তু সেই স্বীকৃতি বরাবরই নাজুক অবস্থায় থেকেছে।

এখন যদি এই শাসকেরা সরাসরি জনগণের মতামত ও আহ্বানে সাড়া দেন, তাহলে তাঁরা নিজ দেশের মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হতে পারবেন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়ানোর মাধ্যমে তাঁরা জনগণের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন। আসলে নিজ দেশের জনগণের সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর নিবিড় বন্ধনের একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম।

 আরব শাসকেরা যেদিন নিজ দেশের জনগণের সঙ্গে একীভূত হয়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে পারবেন, সেদিনই মূলত তাঁরা প্রকৃত সার্বভৌম শাসকের মর্যাদা পাবেন। তার আগে নয়।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • মুহান্নাদ আয়াশ জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করা লেখক ও কানাডার মাউন্ট রয়্যাল ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক