প্রথম দেখায় ‘জনারণ্যে একা’ শব্দযুগলই মনে আসে। ফুটপাতের একধারে এমনভাবে বসে ছিলেন, তাঁর উপস্থিতি যেন উপেক্ষা শব্দটিকেই মূর্ত করে তুলেছে! ‘চোখে পড়ার মতো’ একটা কিছু খুঁজে পাওয়া ভার—কি পোশাকে, কি ভঙ্গিতে।
শারীরিক গড়নও আলাদা করে কিছু বলে না; ছোটখাটো মানুষ, অনুজ্জ্বল চোখ, গায়ের রং কালো। তাঁর সাজানো পসরা বরং দৃষ্টিকে টেনে নেওয়ার মতো কিছুটা ‘আকর্ষক’; ছোট্ট ঝুড়িতে রাখা টাটকা কিছু পেয়ারা।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুটি চরণ আছে এমন—‘রাজা দেখলাম, রানি দেখলাম/ এবার একটু মানুষের কাছে বসতে চাই।’ এমন একজনকে দেখেই কবির ভাবনায় চরণ দুটি দোলা দিয়েছিল বলে মনে প্রতীতি জন্মায়; তাঁর পাশে বসতে ইচ্ছা করে।
জীবন নিয়ে একফোঁটাও খেদ না থাকা এই মানুষটির নাম মো. আবদুল খালেক। বয়স বললেন, ৭০-৭২ বছর হবে। অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের মতো তাঁরও দুই ঠিকানা; অস্থায়ীটি রাজধানীর হাজারীবাগের এক রিকশা গ্যারেজ। গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া ইউনিয়নের শৌলদি গ্রামে।
আবদুল খালেকের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে দারুণ এক সরলাঙ্ক শেখা হলো। মানুষটির মতো সরল তাঁর রোজকার হিসাবও। খাওয়া বাবদ দৈনিক বরাদ্দ ৮০ থেকে ১০০ টাকা। কীভাবে সম্ভব! আবদুল খালেকের জবানিতেই শোনা যাক সে কথা। জানালেন, সকালে ১০ টাকার ভাজি ও ১০ টাকার রুটি। নাশতা শেষ। দুপুরে ১০ টাকার ভাজি ও ১০ টাকার ভাত। ব্যতিক্রম কিছুটা রাতে। কোনো রাতে ডিম খান তো, কোনো রাতে ছোট এক টুকরা মাছ।
রিকশার গ্যারেজে রাত কাটান, মানে তিনি একাই থাকেন। আদতে তিনি ‘একা’ও। স্ত্রী মারা গেছেন। দুই ছেলের আলাদা সংসার। ঢাকাতেই থাকেন তাঁরা; একজন রিকশা চালান, অন্যজন বাবুর্চি। তাঁদের নিজেদেরই টানাটানি, অতএব বাবার পেট বাবাকেই চালাতে হয়।
আবদুল খালেককে তাই এখনো প্রতিদিন কাজে বেরোতে হয়, নিজের খাবারের টাকা নিজেকেই জোগাড় করতে হয়। শুধু নিজের নয়, এক মেয়ে ও মেয়ের এক বছর বয়সী শিশুসন্তানের দায়িত্বও তাঁর ঘাড়ে। দুই মেয়ের মধ্যে বড়টি বিয়ের পর মোটামুটি ভালো আছেন। কিন্তু ছোটটির ‘কপাল পোড়া’। বিয়ে হয়েছিল এক মাদকাসক্ত তরুণের সঙ্গে। সংসার টেকেনি। তত দিনে মা হয়েছেন; কোলের সেই সন্তানকে নিয়ে ফিরে এসেছেন বাবার বাড়ি।
এক দিনের জন্যও পাঠশালায় যাওয়া হয়নি। কিশোর বয়স থেকে জাল টানা শুরু আবদুল খালেকের। অর্থাৎ জেলেনৌকায় মাছ ধরতে যেতেন নদীতে। তাঁর ভাইও একই কাজ করতেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর কমজোরি হয়ে পড়ায় সেই কাজে ক্ষান্ত দিতে হয়। ১০-১২ বছর আগে জীবিকার খোঁজে আসেন ঢাকায়, যেভাবে হররোজ শত শত মানুষ আসেন এ শহরে।
আবদুল খালেকের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে দারুণ এক সরলাঙ্ক শেখা হলো। মানুষটির মতো সরল তাঁর রোজকার হিসাবও। খাওয়া বাবদ দৈনিক বরাদ্দ ৮০ থেকে ১০০ টাকা। কীভাবে সম্ভব! আবদুল খালেকের জবানিতেই শোনা যাক সে কথা। জানালেন, সকালে ১০ টাকার ভাজি ও ১০ টাকার রুটি। নাশতা শেষ। দুপুরে ১০ টাকার ভাজি ও ১০ টাকার ভাত। ব্যতিক্রম কিছুটা রাতে। কোনো রাতে ডিম খান তো, কোনো রাতে ছোট এক টুকরা মাছ। হোটেলওয়ালা পরিচিত। অতএব কোনো রাতে যদি এক টুকরা মাংসও খান, বিল ৪০ থেকে ৫০ টাকার বেশি হয় না। গ্যারেজে রাত কাটাতে পয়সা লাগে না।
কিন্তু যে পরিমাণ ‘পণ্য’ দেখা গেল আবদুল খালেকের ঝুড়িতে, তা বিক্রি করে কয় টাকাই–বা লাভ হয়! মেয়ে-নাতির জন্য কতটা কী টাকা পাঠাতে পারেন? তারও সরল হিসাব দিলেন আবদুল খালেক। সকালে হেঁটে হাজারীবাগের গ্যারেজ থেকে পুরান ঢাকার সিকশন এলাকায় যান। পেয়ারা বা অন্য ফল কেনেন এক ক্যারেট (২৪ কেজি)। জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সেই পণ্য নিয়ে আসেন রিকশায় করে; ভাড়া ৫০ টাকা। দিন শেষে সব পণ্য বিক্রি হলে লাভ থাকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
১০ ডিসেম্বর বেলা দেড়টা নাগাদ কথা হচ্ছিল আবদুল খালেকের সঙ্গে, তখন পর্যন্ত ২৪ কেজির মধ্যে মাত্র ৩ কেজি বিক্রি করতে পেরেছিলেন। বললেন, আজ ভেবেছিলেন বেল আনবেন। কিন্তু চলে কি না, সেই চিন্তা করে আর আনেননি।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’–এর গল্প পুরোনো হয়ে গেছে। তবে আবদুল খালেকের কোনো মুঠোফোন নেই। মেয়ের কাছে একটা বাটনওয়ালা মুঠোফোন আছে বটে। সেই নম্বর লেখা আছে কাগজে, দরকারে কারও কাছ থেকে ফোন করেন। মাসে একবার বাড়ি যান। মেয়ে ও নাতির জন্য সদাইপাতি করে দিয়ে আবার ফিরে আসেন কর্মস্থলে।
এই যে গোটা জীবনই কেটে গেল, কিছু কি জমাতে পেরেছেন বা জায়গাজমি হয়েছে কিছু? প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসেন আবদুল খালেক। বললেন, বাবার কাছ থেকে দুই কানি জমি পেয়েছিলেন ভাগে, উল্টো সেটাও বিক্রি করে খেয়েছেন। এরপর অর্থের পিছে ঘুরতে থাকা পৃথিবীকে মুহূর্তের তরে থমকে দেওয়ার মতো উচ্চারণ করলেন—‘দালানকোডা দিয়া কী হরমু?’ এমন লোভশূন্য, সরলতায়পূর্ণ মানুষও হয়—এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হুমকিতে পড়া ২০২৩ সালেও!
পড়তে জানেন না, টিভিও দেখা হয় না কখনো। তাই গোটা দুনিয়া কী চলছে বা ফিলিস্তিনে বয়ে চলা নারকীয় তাণ্ডব সম্পর্কেও জানা নেই তাঁর! এমনকি দেশের হালহকিকতও অজানা! এমন অকৃত্রিম মানুষকে হুমকিতে ফেলে, এমন সাধ্য কোন কৃত্রিমতার?
কবি আবুল হাসান যেমন বলেছেন ‘নিম্নমানের মানুষ’; এই মানুষটি যেন সেই ‘মানরেখা’কেও অস্বীকার করলেন, অনায়াসে! আহা! নইলে কোন ‘সাহসে’ একজন কপর্দকশূন্য মানুষ বলতে পারেন—‘আল্লাহ যে রহম রাখছে, শুকরিয়া!’
কবি ভুল বলেননি। আবদুল খালেকদের মতো মানুষদের হাতেই ‘চামেলী’ শোভা পায়।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
hello.hasanimam@gmail.com