পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বন্দুকধারীরা ২০ জন খনিশ্রমিককে হত্যা করেছে। গুরুতর আহত হয়েছে সাতজন। গত শুক্রবার এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। বেলুচিস্তান প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
কয়েক দিন পরে রাজধানী ইসলামাবাদে একটি বড় নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ঠিক এর আগে আগেই পাকিস্তানের অশান্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে এই হামলার ঘটনা জাতীয় পর্যায়ে এক অস্থিরতা তৈরি করেছে। হামলার উদ্দেশ্যও কি তা-ই ছিল? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সে বিষয়ে জোর আলোচনা করছেন।
ঘটনা ঘটেছে বেলুচিস্তানের হারনাই জেলার তহসিল দাকির কয়লাখনিতে। নিহত ব্যক্তিরা এই কয়লাখনির শ্রমিক। নিহত খনিশ্রমিকদের মধ্যে পাকিস্তানি নাগরিক ছাড়া আফগানও রয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে দাকি থানার স্টেশন হাউস অফিসার (এসএইচও) হুমায়ুন খান জানিয়েছেন, গভীর রাতে একদল সশস্ত্র লোক ভারী অস্ত্র নিয়ে দাকি এলাকার খনিটিতে হামলা চালায়। এখানকার অধিকাংশ শ্রমিক বেলুচিস্তানের পশতুনভাষী এলাকার বাসিন্দা। কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলাকারীরা রকেট ছুড়েছে এবং গ্রেনেডও নিক্ষেপ করেছে।
কোনো গোষ্ঠী তাৎক্ষণিকভাবে হামলার দায় স্বীকার করেনি, তবে নিষিদ্ধ বালুচ লিবারেশন আর্মিকে এই হামলার জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে। এরা প্রায়ই বেসামরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা করে থাকে।
গোষ্ঠীটি গত আগস্ট মাস থেকে ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে ৫০ জনের বেশি লোক হত্যা করেছে। শাসকদের পক্ষ থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ২১ জনকে হত্যা করে পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়া হয়।
বেলুচিস্তানের খনিতে কাজ করা শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে। বেলুচিস্তানের কুচি জেলার মছ এলাকায় ঘুমন্ত অবস্থায় ১০ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। পরে তাঁদের হত্যা করা হয়। ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল চরমপন্থী সংগঠন দায়েশ। যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা হাজারা সম্প্রদায়ের।
বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা চেয়ে আসছে প্রদেশটির কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। তাদের অভিযোগ, ইসলামাবাদের ফেডারেল সরকার তেল ও খনিজসমৃদ্ধ বেলুচিস্তানকে নির্মমভাবে শোষণ করছে। এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বেলুচিস্তানের মানুষ রয়ে গেছে অবহেলিত ও দরিদ্র।
৭ অক্টোবর সোমবার, বালুচ লিবারেশন আর্মি দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দরের বাইরে চীনা নাগরিকদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করে। পাকিস্তানে কয়েক হাজার চীনা নাগরিক বেইজিংয়ের বহু বিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে কাজ করছেন।
বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির হামলার পর পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন বা সেই অনুষ্ঠানে আগত বিদেশিদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
আগামী সপ্তাহে ইসলামাবাদ সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করছে। কর্তৃপক্ষ রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এই সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পাকিস্তানের চারটি প্রদেশকে সতর্ক করেছে। কারণ, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানি তালেবান জনসমাগমপূর্ণ এলাকা এবং সরকারি স্থাপনায় হামলা করতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে।
চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলায় ৭৫৭ জন নিহত হয়েছে। সর্বশেষ হামলাসহ সেই সংখ্যা দাঁড়াল ৭৭৭। আহত হয়েছেন আরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা বন্ধ করতে সরকারের আরও ভালো পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
বর্তমানে হামলাকারীরা দেশের দুটি প্রদেশ, খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তানে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছে। এই দুই প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের সঙ্গে। ইসলামাবাদ বারবার পাকিস্তানে হামলার জন্য উগ্রপন্থী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) দায়ী করে আসছে।
এর বাইরে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মিও বেলুচিস্তানে সক্রিয় রয়েছে। পাকিস্তান আফগান তালেবানকে পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের সমর্থন করার অভিযোগ করে থাকে। যদিও কাবুলের ক্ষমতায় থাকা আফগান তালেবানরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক এহসানুল্লাহ মো. টিপু মেহসুদ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে ‘রাষ্ট্রের অবহেলা’ বর্তমান পরিস্থিতির প্রধান কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে অর্জিত সুবিধা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়নি।
এহসানুল্লাহর মতে, আশরাফ গনির সময় আফগানিস্তানের সঙ্গে কোনো সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া জোরালো হয়নি। এর ফলে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আবার জমিয়ে বসার সুযোগ পায়।
পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক ও পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক মালিহা লোধি বলেছেন, আফগান তালেবান সহিংসতা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে জঙ্গি হামলা বৃদ্ধির বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো (আফগান) তালেবান কর্তৃপক্ষের টিটিপির লাগাম টেনে ধরতে অস্বীকৃতি। অথচ সংগঠনটি আফগানিস্তান থেকেই পালিয়ে পাকিস্তানে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। আর এখন তারা পাকিস্তানে হামলা অব্যাহত রেখেছে।’
বেলুচিস্তানে সাম্প্রতিক সহিংসতার বৃদ্ধি ‘পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার একটি বহিরাগত প্রচেষ্টা’ বলে মাহিরা লোধি মনে করেন।
আমেরিকান থিঙ্কট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মাদিহা আফজালের মতে, আফগানিস্তানের তালেবান কর্তৃপক্ষ টিটিপিকে সন্ত্রাসবাদের জন্য ‘লজিস্টিক স্পেস’ দিচ্ছে।
যাহোক, তিনি এ–ও বলেছেন যে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের উত্থানের জন্য পাকিস্তানি নেতৃত্বও দায়ী। তাঁরা অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রশমন করার বদলে ক্র্যাকডাউন পদ্ধতি অবলম্বন করতে পছন্দ করেন। এর ফলাফল ইতিবাচক হওয়ার কথা নয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে সরকারকে আরও ভালো কৌশল সামনে নিয়ে আসতে হবে। সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সব প্রক্রিয়ার মধ্যে জনসমর্থন অর্জনে মনোযোগ দিতে হবে।
এহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদ পাখতুনখাওয়া এবং বেলুচিস্তান সম্পর্কে বলতে গিয়ে মত ব্যক্ত করেন যে ‘দেখা যাচ্ছে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে জনগণের সমর্থন নেই। এটা খুব উদ্বেগজনক। জনগণ বরং মনে করে যে তাদের এলাকাগুলো থেকে সন্ত্রাসবাদী ও সেনাবাহিনী, এই দুই পক্ষকেই সরিয়ে ফেলা উচিত।’ মানুষের জীবন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তারা সন্ত্রাসী বা সেনাবাহিনী যে–ই হোক। কোনো পক্ষকেই তারা তাদের স্বার্থের রক্ষক বলে মনে করছে না। বিশ্বাসের এই ফাটলকে কাজে লাগাচ্ছে বিদ্রোহীরা।
তবে যে প্রক্রিয়া বা যে কৌশল কাজে লাগানোর কথা ভাবা হোক না কেন, মনে রাখতে হবে, এই দুই প্রদেশে সন্ত্রাসবাদ বন্ধে সবার আগে যা নিশ্চিত করা উচিত, তা হচ্ছে জনসমর্থন।
হারুন জানজুয়া পাকিস্তানের সাংবাদিক
ডয়চে ভেলে উর্দু থেকে নেওয়া। অনুবাদ: জাভেদ হুসেন