মতামত

সংসদে তোফায়েল আহমেদকে যা বলার সুযোগ পাইনি

আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

কথাগুলো বলা খুব সহজ ছিল না সেদিন। আমার রাজনীতির বয়স মাত্রই এক দশক পূর্ণ হয়েছে। এখনো সব অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার চুপ করে মেনে নেওয়ার মতো নির্বিকার বা নির্দয় হয়ে উঠতে পারিনি আমি। এখনো সহযোদ্ধার রক্ত রক্তাক্ত করে আমাকে। ভেতরের ক্ষোভ, রাগ, কষ্ট চেপে, ধীরে-আস্তে কোমল স্বরে প্রতিবাদ করা শিখে উঠতে পারিনি এখনো। রপ্ত হয়নি রাবীন্দ্রিক ভাষায় নিজের ভেতরের ক্ষোভ প্রশমন। তা ছাড়া রক্ত বড় নিষ্করুণ—সে তার পাওনা কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে ছাড়ে। আমার প্রয়াত পিতা অলি আহাদ ছিলেন তাঁর স্পষ্টবাদিতা আর চাঁছাছোলা ভাষার জন্য বিখ্যাত।

পারিবারিকভাবেই কোনো শক্ত কথা নরমভাবে তুলতুলে ভাষায় বলা শিখিনি আমি। আর রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা ঠান্ডা মাথায় রাজনৈতিক হত্যার প্রতিবাদ সত্যিই কি কোমল স্বরে হতে পারে? হয়েছে কখনো? তবে কিনা এখন সময়টা ভিন্ন। রাজনীতি বদলে গেছে, বদলে গেছে রাজনীতির ভাষাও। বছরের পর বছর বিরোধী দলবিহীন একদলীয় একটি সংসদ ভুলে গেছে সমালোচনা আর প্রতিবাদ কী করে নিতে হয়। প্রশংসায় মোড়া ‘যদি/কিন্তু’র কুসুম কুসুম বিরোধিতা এখন সর্বত্র। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমার কণ্ঠ কর্কশ শোনাবে, মনে হবে যেন ঝগড়া করছি, তা খুবই স্বাভাবিক।

সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা এমনিতেই অল্প, এর মধ্যে আলোচনায় অংশ নেয় হাতেগোনা দুই-একটি। সংসদ অধিবেশন বসেও খুব অল্প সময়ের জন্য। অথচ আলোচনা করার মতো বিষয় অগুনতি। তাই যেটুকু সময় বরাদ্দ পাই, তা এতই অপ্রতুল যে এর প্রতিটি মাইক্রোসেকেন্ড কাজে লাগাতে গিয়ে কথা বলি অতি দ্রুত আর চারপাশ থেকে ওঠা হইচই ছাপিয়ে কথাগুলো যেন শোনা যায়, তাই কিছুটা উচ্চ স্বরে তো বটেই। আমি জানি, দফায় দফায় আর সবার সময় বাড়লেও, (বিশেষ করে সরকারি দলের হলে তো কথাই নেই) আমার ক্ষেত্রে সেটি এক/দুই মিনিটের বেশি কখনোই হবে না। হয়তো এই সবকিছু মিলিয়েই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ সাহেবের মনে হয়েছে, আমার সাংঘাতিক আক্রমণাত্মক ভাব, বলি একতরফা, মনে হয় যেন ঝগড়া করার জন্য এসেছি। তিনি কিছু নাম উল্লেখ করে পরিষ্কার করেন শান্ত, মিষ্টি ভাষায় যাঁরা সংসদে প্রতিবাদ করেন, আমি তাঁদের একজন নই, যদিও সেভাবে বলাটাই নিয়ম। অবশ্য সেই সঙ্গে এ-ও বলেন, আমার ‘ভয়েস’টাই অন্য রকম, আল্লাহপ্রদত্ত, তাই তাঁরা কিছু মনে করেন না।

তাঁর এই বক্তব্যে সংসদজুড়ে হাসির রোল ওঠে, বোঝা যায় সবার বেশ মনঃপূত হয়েছে ওনার কথা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অবিসংবাদিত এই নেতা তাঁর বক্তব্যে অবশ্য বারবার বলতে ভোলেননি, তিনি আমাকে সম্মান ও স্নেহ করেন। একজন অভিজ্ঞ ও ঝানু রাজনীতিবিদ এবং সংসদ সদস্যের কাছ থেকে এমন মন্তব্য নিশ্চয়ই এই কনিষ্ঠ সংসদ সদস্যকে উদ্দীপ্ত করবে।

দীর্ঘ ষাট দিন পর এবারের সংসদ অধিবেশনটি বসেছিল মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। দুই অধিবেশনের মধ্যকার বিরতি আর আইন পাসের জন্য সংসদের একটা ‘রাবার স্ট্যাম্প’ থাকা সাংবিধানিকভাবে অত্যাবশ্যক না হলে সংসদ সম্ভবত বসতই না। সংসদ বসার আগেই দেশজুড়ে চলছিল বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে আমরা হারিয়েছি তিনটি তাজা প্রাণ। দুজন ভোলায়, একজন নারায়ণগঞ্জে। আহত হওয়া, মামলা খাওয়া, ভাঙচুর আর ১৪৪ ধারা জারির কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। স্বাভাবিক কারণেই পয়েন্ট অব অর্ডারে এই বিষয়ে বলতে দাঁড়িয়েছিলাম আমি।

প্রধানমন্ত্রীর আশ্বস্ত করার কথা যদি সরিয়েও রাখি, আমাদের সংবিধানই তো সভা-সমাবেশ করার পূর্ণ অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৭) দিয়েছে আমাদের। তারই জবাব দিতে দাঁড়িয়েছিলেন বর্ষীয়ান ঝানু সংসদ সদস্য জনাব তোফায়েল আহমেদ। আমার সাড়ে ৫ মিনিটের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন ১১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড।

পাঁচ মিনিট উনচল্লিশ সেকেন্ডের বক্তব্যে যত দূর সম্ভব প্রতিবাদ করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী বারবার আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও কেন এমন ঘটনা ঘটল, পুলিশের বিরুদ্ধে ন্যূনতম তদন্তের উদ্যোগ কেন নেওয়া হলো না, বরগুনায় ছাত্রলীগের ওপর সামান্য লাঠিপেটার দায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে যদি মুহূর্তের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে বিরোধী দলের তিনটি তাজা প্রাণ স্রেফ গুলি করে মারার জন্য কেন সরকারের তরফ থেকে টুঁ শব্দটিও করা হলো না? এটুকু লিখেই মনে হলো, প্রশ্নটি ঠিক হয়নি, বর্তমান বাংলাদেশে সঠিক প্রশ্ন হওয়ার কথা ছিল—বিএনপি কর্মীদের গুলি করে হত্যা করা পুলিশকে ঠিক কী কী দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে?

প্রধানমন্ত্রীর আশ্বস্ত করার কথা যদি সরিয়েও রাখি, আমাদের সংবিধানই তো সভা-সমাবেশ করার পূর্ণ অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৭) দিয়েছে আমাদের। তারই জবাব দিতে দাঁড়িয়েছিলেন বর্ষীয়ান ঝানু সংসদ সদস্য জনাব তোফায়েল আহমেদ। আমার সাড়ে ৫ মিনিটের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন ১১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। ধীরেসুস্থে দেওয়া বক্তব্যের শেষে তিনি নিজেই বলেন, পয়েন্ট অব অর্ডারে তিনি আর সময় চান না। অন্যদিকে আমার ক্ষেত্রে সাড়ে পাঁচ মিনিটের মাথায় মাইক অফ করে দেওয়া হয়। পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, কার সঙ্গে কার তুলনা টানছি আমি। না, তুলনা আমি করছি না; অতটা বোকা আমি নই।

ভোলায় বিএনপির দুই কর্মীর গুলিবিদ্ধ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেন, ভোলার ছেলেটি নিজের ছুড়ে মারা ইটের আঘাতে নিজেই মারা যান। আবার সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, মিছিলে থাকা ছাত্রদলের ছেলেদের মারা ইট-পাটকেলের আঘাতে মারা যান তিনি। সেখানে আওয়ামী লীগের মিছিল বা কিছু ছিল না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, পুলিশই বা করবে কী? নেমেই যদি বিএনপি শুরু করে, তাহলে তো কিছু করার থাকে না। তাঁর ১১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের পয়েন্ট অব অর্ডারে দেওয়া বক্তব্যের জবাবে দ্বিতীয়বার বলার সুযোগ আমি পাইনি। তাই এই লেখা।

ভোলার আবদুর রহিম আর নুরে আলম মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে, ইট-পাটকেলের আঘাতে নয়। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর এই ঘটনা বীভৎস, কারণ যেভাবে মাথা ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই দুজনের মৃত্যু হয়েছে, তাতে আলামত মেলে, হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি চালানো হয়েছিল। নয়তো মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য শূন্যে গুলি ছুড়ে ভয় দেখানোর কথা। খুব বেশি হলে শরীরের নিচের দিকে, অর্থাৎ পায়ে গুলি করার কথা, মাথায় বা বুকে নয়। জনাব তোফায়েল আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো ইট-পাটকেলের আঘাতে মৃত্যুর বয়ান কিসের ভিত্তিতে আনলেন, আমার জানা নেই।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান মতে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ করে মিছিলের প্রস্তুতি নিতেই পুলিশ তাতে বাধা দেয় এবং ব্যানার ছিনিয়ে নেয়। এতে সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বাধা উপেক্ষা করে মিছিলের চেষ্টা করেন এবং দুই পক্ষের সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবদুর রহিম। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। এর মধ্যে নুরে আলমসহ ছয়জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হলে নুরে আলম মারা যান। মজার বিষয় হচ্ছে, বিএনপি কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ যে মামলা করেছে, তাতে বিএনপিরই অজ্ঞাতপরিচয় শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এই হলো এ দেশে বিরোধী দলের ওপর সরকারি নিপীড়নের আইনগত পরিণতি।

হত্যার রাজনীতি এখানেই শেষ নয়। বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১ সেপ্টেম্বর জেলা ও মহানগর বিএনপির উদ্যোগে শোভাযাত্রা করতে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকার আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগারের সামনে নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএনপির কয়েক শ নেতা-কর্মী শোভাযাত্রা বের করতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ লাঠিপেটা করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছোড়ে। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গুলিতে নিহত হন যুবদল কর্মী শাওন প্রধান (২০) আর গুলিবিদ্ধ হন ২৬ জন।

অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটেছে শাওনকে নিয়ে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শাওনকে আওয়ামী লীগ বানানোর হাস্যকর চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি যদি আওয়ামী লীগ কর্মীই হবেন, তবে তাঁর লাশ কেন দাফন করতে হবে গভীর রাতে কড়া পুলিশি প্রহরায়? শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে যুবদলের মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে কী করছিলেন তিনি? তাঁর ফেসবুকেও তিনি নিজেকে যুবদলের কর্মী বলে পরিচয় দেবেন কেন? সেটায় ব্যর্থ হলে মামলার এজাহারে পুলিশকে দায়মুক্তি দিতে বলা হয়েছে, শাওন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছোড়া ইট ও আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে গুরুতর জখম হয়ে মারা যান। ঠিক ভোলার গল্পেরই পুনরাবৃত্তি যেন।

নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর এক ডিবি পুলিশের চায়নিজ রাইফেল হাতে গুলি করার ভাইরাল ছবিতে আমরা খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, বন্দুকের নল তার টার্গেটের বুকে তাক করা, শরীরের নিচের দিকে নয়। কোনো ডিবি পুলিশ তাঁর নামে বরাদ্দকৃত নয়, এমন একটা সামরিক গ্রেডের অস্ত্র দিয়ে গুলি করছেন বিএনপি কর্মীকে হত্যার উদ্দেশ্যে—এটুকু তথ্যই যথেষ্ট বিএনপির প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য।

আমি সত্যি জানি না, সরকারের এসব ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিষ্টি ভাষায় করা যায় কী করে। শুধু তো নুরে আলম, আবদুর রহিম বা শাওন প্রধান হত্যাকাণ্ড নয়। সারা দেশে গত ২২ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচিতে সরকার পুলিশ এবং নিজ দলীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা হামলা চালিয়ে নিহত, আহত, গ্রেপ্তার ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। সারা দেশে বিএনপির কর্মসূচিতে এই কয়েক দিনে পুলিশের হামলা ও গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনজন, আহত দুই হাজারের অধিক এবং দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

এ ছাড়া চার হাজার ৮১ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাসহ ২০ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ২০ থেকে ২৫টি স্থানের কর্মসূচিতে ১৪৪ ধারা দিয়ে সরকার সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিএনপির কর্মসূচি বন্ধ করেছে। সারা দেশে কমপক্ষে ৫০টি স্থানে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালিয়েছে।

জনাব তোফায়েল আহমেদ তাঁর বক্তব্যে বারবার আইয়ুবের সময়কার আন্দোলনের কথা বলছিলেন। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন তিনি। সেই আন্দোলন দমন করতে ধাপে ধাপে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করেছিলেন, সেটাকে সেই সময়ের মাপকাঠিতে অনেক বেশি মনে হলেও আজকের বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের দমন-পীড়নের তুলনায় তুচ্ছই মনে হচ্ছে। সরকারি দল কি তা বুঝতে পারছে?

  • রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী