আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে কিশোর প্রজন্মকে কীভাবে রক্ষা করা যাবে

কিশোর-কিশোরীদের নানা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি একটি বৈশ্বিক সংকট, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে এই মানসিক সমস্যাগুলো বিশ্বের নানা দেশে, নানা সমাজে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৈশোরকাল মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বস্তুত শৈশব ও যৌবনের মধ্যবর্তী সময়টাই হলো কৈশোরকাল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুযায়ী, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা হলো কিশোর ও কিশোরী। এই বয়ঃসন্ধিক্ষণে মানবজীবনে নানা পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। বিশেষ করে সবে ফেলে আসা মাতৃক্রোড়ে লালিত শৈশবের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে অবাক বিস্ময়ে সে দেখতে পায় পৃথিবীর নতুন রূপ-রস আর বিচিত্র এক অনুভূতি, যা এত দিন তার কাছে ছিল অজ্ঞাত। এই সময়কালে কিশোর-কিশোরীর শরীরের গঠনপ্রক্রিয়া ও দেহতত্ত্বে সূচিত হয় পরিবর্তন এবং দেহাভ্যন্তরে বহমান শারীরিক রসায়নেও আসে পরিবর্তনের ধারা। এ সময় তারা যে নবতর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতেও সংকোচ বা বিব্রত বোধ করে। এ থেকে জন্ম নেয় একধরনের অস্থিরতা, যা তাদের কোমল হৃদয়কে করে আচ্ছন্ন। এগুলোর সম্মিলিত প্রভাবে সৃষ্টি হয় নানা আবেগীয় সমস্যা। এ সময়ের কিছু উপসর্গ হলো বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, দেহ-মনে একধরনের অস্থিরতা ও উদ্বেগ। কৈশোরে তীব্র উদ্বেগের কারণে দেহে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং অল্পবয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।

সমস্যা আরও তীব্রতর হয়, যখন এ বয়সের ছেলেমেয়েদের মাঝে ‘প্রত্যাহারমূলক মনোভাব’ অর্থাৎ সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলার প্রবণতা জন্ম নেয়। তারা নিজেকে উৎসব-আনন্দ, উচ্ছলতা বা পারিপার্শ্বিক কর্মকাণ্ড থেকে গুটিয়ে ফেলে। কারও সঙ্গে মিশতে চায় না এবং নিজের সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার কাল্পনিক বলয় সৃষ্টি করে। এই প্রত্যাহার করার মনোভাব তাদের প্রলুব্ধ করে সাময়িকভাবে ভুলে থাকার প্রবণতায়। তারা সাড়া দেয় নেশা, মাদক তথা বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে। কেউ আবার আশ্রয় নেয় দিনরাত মুঠোফোন বা কম্পিউটারে ডুবে থাকার মধে৵। কী দেখছে কম্পিউটারে, সেই ভালোমন্দ বিবেচনা করার কোনো প্রয়োজন সে অনুভব করে না। কিন্তু এই নেশাও যাদের মানসিক যাতনা উপশম করতে পারে না, তখন চরম একটি পন্থার কথা তাদের মনে উঁকি দেয়। আর সেটি হচ্ছে এই জীবনের অবসান ঘটানো। হতাশার চূড়ান্ত পরিণতিতে জন্ম নেয় আত্মহননের প্রবণতা।

মানসিক স্বাস্থ্যের এই ভয়ংকর দিক আমাদের সমাজ এখনো পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনি । অনেকেই ধরে নেন, ‘এটি একটি সাময়িক অসুবিধা মাত্র, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বাইরে থেকে তারা বুঝতে পারেন না দিনে দিনে কীভাবে একজন তরুণ অবর্ণনীয় যাতনায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন। উন্নত চিকিৎসার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো অনেকদূর এগিয়েছে ঠিকই, তবে মানসিক স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সেখানে এখনো পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব রয়েছে। সেসব দেশে কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলাপ–আলোচনা হয় ঠিকই কিন্তু এর প্রয়োগ এখনো ব্যাপকতা লাভ করেনি।

এ পর্যায়ে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, যাকে ইংরেজিতে ট্রমা বলা হয়। একটি আকস্মিক ও চরম আকারের মানসিক আঘাতের ফলে ‘ট্রমা’ সৃষ্টি হতে পারে। হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা, যুদ্ধবিগ্রহ, ধর্ষণ, আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি পরিস্থিতি থেকে ট্রমার উদ্ভব হয়ে থাকে। দেখা গেছে যে ট্রমায় আক্রান্ত ব্যক্তির রোগমুক্তির ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং একটি সফল ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।  কিন্তু কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণের প্রবণতা এখনো  সীমিত রয়ে গিয়েছে।  

আত্মহননের প্রবণতা থেকে কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। পারিবারিক সচেতনতা, সামাজিক সহমর্মিতা এবং বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের অঙ্গীকার একীভূত হলেই এ ক্ষেত্রে রচিত হতে পারে বাংলাদেশে সাফল্যের আরও একটি মাইলফলক।

বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশে ২০২২ সালে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ৪৪৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ২৮৫ জন ছেলে ও ১৬৮ জন মেয়ে। এদের মধ্যে ৫৪ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীও রয়েছেন। একই সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন। এই প্রবণতা উদ্বেগের কারণ, হয়ে দাঁড়িয়েছে যা উপেক্ষা করার আর কোনো অবকাশ নেই ।

অল্প বয়সী মানুষের মধে৵ ক্রমবর্ধমান এই হতাশাগ্রস্ত ব্যাধি থেকে কীভাবে তাদের নিরাপদ রাখা যায় তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তর গবেষণা ও নিরীক্ষা চলমান। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার ও বিশ্বাসভাজন নিকটজন। নিজ পরিবার,  বন্ধুজন, শিক্ষক—সবাই যদি এই সময়টায় এগিয়ে আসেন, তাহলে অনেক সহজে কিশোর ও তরুণ বয়সে এসব মানসিক সমস্যা, উদ্বেগ ও হতাশা থেকে তাদের মুক্ত করা অনেকটা সহজ হয়ে উঠতে পারে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রথমেই জানতে হবে যে তারা কী ধরনের অস্থিরতা বা অসহনীয় যাতনার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। একটি নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি হলে আক্রান্ত কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী এগিয়ে আসবে নিজের কথাগুলো খুলে বলার জন্য। তখন সে অকপটে প্রকাশ করবে নিজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয়ভীতি বা অস্থিরতার উৎস কোথায়।

মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে । দেশে একটি মানসিক স্বাস্থ্যনীতি রয়েছে এবং এর সঙ্গে রয়েছে একটি মানসিক স্বাস্থ্যকৌশলও (২০১৯)। যেহেতু মানসিক চিকিৎসা গ্রহণের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে যাওয়ার মতো ব্যাপক সচেতনতা এখনো এদেশে সৃষ্টি হয়নি, তাই প্রয়োজন হচ্ছে চিকিৎসা বা উপদেশ প্রদানের সক্ষম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রোগীর কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে এ ধরনের সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি) চালু করেছে ‘ব্র্যাক প্যারা কাউন্সেলর মডেল'। এর আওতায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা একটি প্যারাকাউন্সেলর গ্রুপ তৈরি করছে। আক্রান্ত পরিবারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসুস্থ মানুষের বাড়িতে গিয়ে রোগীর কথা শুনছে এই প্যারাকাউন্সেলর গ্রুপ এবং তাদের সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উপদেশ বা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

আত্মহননের প্রবণতা থেকে কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। পারিবারিক সচেতনতা, সামাজিক সহমর্মিতা এবং বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের অঙ্গীকার একীভূত হলেই এ ক্ষেত্রে রচিত হতে পারে বাংলাদেশে সাফল্যের আরও একটি মাইলফলক।

তাবাস্‌সুম আমিনা সহকারী অধ্যাপক, টিম পরিচালক, মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তা, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়