মতামত

জনশুমারি–উত্তর যাচাই হোক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ

একটি শুমারি সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে কাজটি কেমনভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তার ওপর।
ছবি : প্রথম আলো

দেশের সব ব্যক্তির জনমিতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্য সংগ্রহ, সংকলন ও প্রকাশের সার্বিক প্রক্রিয়াই হলো জনশুমারি। শুমারির সঠিক উপাত্তের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হয়।

এ প্রেক্ষাপটে দেশের ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রথম ডিজিটাল শুমারির তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম গত ১৫ থেকে ২১ জুন দেশব্যাপী পরিচালিত হয়; যদিও এ শুমারি হওয়ার কথা ছিল দেড় বছর আগেই। তবে শুমারিকালে আকস্মিক বন্যার কারণে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোনা জেলায় তথ্য সংগ্রহের সময়সীমা ২৮ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ডিজিটাল ডিভাইস (ট্যাবলেট ব্যবহার করে কম্পিউটারের সহায়তায় ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার-ক্যাপি পদ্ধতিতে) ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করে এবং দ্রুততম সময়ে (শুমারি–পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই) গত ২৭ জুলাই ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ প্রাথমিক প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ শুমারির বিভিন্ন তথ্য নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ও উদ্বেগ বিভিন্ন প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়াতে লক্ষ করা যায়। শুমারির কাজটি বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করতে হয়। লক্ষণীয়, কোনো শুমারিই শতভাগ নির্ভুল বলে দাবি করা যায় না। ফলে কী ধরনের এবং কী পরিমাণ ভ্রান্তি ঘটেছে, তা নিরূপণ করার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি রয়েছে, যা জাতিসংঘের নির্দেশিত গাইডলাইন অনুযায়ী স্বাধীন-নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দ্বারা জনশুমারি-উত্তর যাচাইকাজ সম্পাদন, প্রতিবেদন প্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়।

শুমারিতে সাধারণত দুই ধরনের ভ্রান্তি আমরা লক্ষ করতে পারি—কাভারেজ ইরোর ও কনটেন্ট ইরোর। কাভারেজ ইরোরের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ মানুষ জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি, বাদ পড়েছে বা দ্বৈত গণনায় এসেছে, তা নির্ধারণ করতে হয়। আর কনটেন্ট ইরোর ঘটে ব্যক্তি, খানা ও হাউজিং ইউনিটের বৈশিষ্ট্যগত অসম্পূর্ণ তথ্যের সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে যেসব ভ্রান্তি ঘটে, তা হলো বাদ পড়া, দ্বৈত গণনায় আসা, ভুল অন্তর্ভুক্তি, গ্রস ত্রুটি ও নিট ত্রুটি। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের শুমারিতে নিট ত্রুটির হার ছিল ৪ দশমিক ৯৮, আর ২০১১ ছিল ৩ দশমিক ৯৮। ২০২২ সালের শুমারিতে কী পরিমাণ ভ্রান্তি ঘটেছে, তা প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশের পর জনশুমারি-উত্তর যাচাই বা নির্ধারণ করে তা সংশোধিত আকারে জনসংখ্যার আকার প্রকাশ করতে হবে। ফলে কী পরিমাণ ভ্রান্তি হয়েছে, তা নির্ধারণ করা এখন অত্যন্ত জরুরি।

তবে এবারের শুমারিতে অতীতের চেয়ে বেশি ভ্রান্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না, এ নিয়ে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা এবারের শুমারি বর্ষাকালে করা হয়েছে। বর্ষাকালে তথ্য সংগ্রহকারীরা দুর্গম এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর প্রকৃত তথ্য জনশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকতে পারেন। তা ছাড়া শুমারি চলাকালে সিলেট ও উত্তরাঞ্চল বন্যাকবলিত ছিল।

কোথাও কোথাও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ব্যাপার ছিল; যেমন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ কারণে শুমারি কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে ওই সব অঞ্চলে। এসব এলাকায় সব মানুষ ও গৃহগণনায় অন্তর্ভুক্তি কঠিন। বন্যাকবলিত এলাকায় খানার গণনা ও খানার বৈশিষ্ট্যসংক্রান্ত তথ্য কীভাবে নির্ভুল পাওয়া যাবে, যেখানে ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে গেছে? তাই এ সময়কে পরিহার করতে পারলে ভালো হতো। তথ্য সংগ্রহকারীরা সব এলাকায় সঠিকভাবে গণনার কাজটি করেছে কি? শুমারি প্রশ্নমালায় ৩৫টি প্রশ্ন সবাইকে করা হয়েছে কি?

বিবিএস ও সরকারের যেকোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে এককভাবে কাজটি অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে সম্পাদন করা। এই মুহূর্তে বিবিএসের উচিত শুমারি-উত্তর যাচাইকাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা—এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে জনমনে আস্থা অর্জন করা। সরকারের উচিত বিবিএসের মতো সরকারি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে বিশেষায়িত দক্ষ জনবল ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। অধিক বিনিয়োগ করা এবং স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা।

গণনায় যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা কেউ কেউ গণমাধ্যমে অভিযোগ এনেছেন এবং যাঁরা আবার গণনায় এসেছেন, তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর নেওয়া হয়নি—এমন অভিযোগও রয়েছে। সব বিদেশি নাগরিককে গণনায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হওয়া গিয়েছে কি? বিদেশে কী পরিমাণ মানুষ রয়েছে, সঠিক উত্তর এসেছে কি? ফলে বর্তমান বাস্তবতায় শুমারিতে কাভারেজ ও কনটেন্ট ইরোর বা ভ্রান্তি অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে।

শুমারি সম্পাদনে বিবিএস হয়তো তাদের মতো যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, ব্যবস্থা নিয়েছে কিন্তু মাঠপর্যায়ে সরকারি–বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ও সহযোগিতায় এ শুমারি সম্পাদন করা হয়েছে কি না, সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তথ্য সংগ্রহকারীর নিয়োগ কেমন ছিল? রাজনৈতিক প্রভাব ছিল কি না, তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন কি না, তা বিশ্লেষণ ও গবেষণার দাবি রাখে।

বর্তমান শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার আকার ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। জনসংখ্যার এ আকার নিয়েও প্রশ্ন এসেছে, যেখানে বিবিএস প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রাক্কলিত তথ্যে ২০২০ সালের ১ জুলাই ১৬ কোটি ৮২ লাখ ২২ হাজার এবং ২০২১ সালের ১ জুলাই ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার উল্লেখ করেছিল। এ ছাড়া শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে লক্ষ করা যায়, ১৭ হাজার ৫০৭টি খানা বা ৮৫ হাজার ৯৫৭ জনের অসম্পূর্ণ তথ্য এসেছে। এ ছাড়া দৃষ্টি দেওয়ার মতো তথ্য, যেমন লিঙ্গানুপাতে প্রথমবারের মতো দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি লক্ষ করা গেছে। সারা দেশে ভাসমান জনসংখ্যা এখন ২২ হাজার ১৮৫, যা ২০১১ সালে ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৪ জন।

বর্তমান শুমারিতে বস্তিবাসী ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮৬ জন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা ১ কোটি ২৭ লাখ ৮ হাজার ৮২২। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫ হাজার ১৫৯, যা আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১-তে ছিল ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে লক্ষ করা যায়, ২০১১ সালের শুমারিতে ২৪টি ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। তবে ২০২২ সালের শুমারিতে ৫০টি জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেওয়া হলেও গত ১১ বছরে বেড়েছে ৬৪ হাজার ১৮ জন। ফলে এ রকম আরও তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রাথমিক গণনায় কী পরিমাণ কাভারেজ ও কনটেন্ট ইরোর ঘটেছে, তা নির্ণয়ে শুমারি-উত্তর যাচাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি শুমারি সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে কাজটি কেমনভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তার ওপর। একটি সফল শুমারি নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংকলন ও তা প্রকাশের ওপর। যেহেতু এখন ডিজিটাল শুমারি, ফলে দ্রুত শুমারি-উত্তর যাচাই, আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ পরিচালনা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে যাঁরা শুমারি-উত্তর যাচাইকাজটি করবেন, তাঁরা যেন স্বাধীনভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন, সংকলন করেন এবং তাঁরাই তা প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে বিবিএস কিংবা সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কাঙ্ক্ষিত নয়।

আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, শুমারি-উত্তর যাচাই জরিপের কাজটি যেহেতু বিআইডিএস করবে বলে সরকার জানিয়েছে, সে ক্ষেত্রে বিবিএসের বাইরে বিআইডিএস নিজে তথ্য সংগ্রহে নমুনায়ন এলাকা নির্ধারণ, তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ ও তত্ত্বাবধায়ক দ্বারা তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রকাশ—এসব কাজই যেন বিআইডিএস স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে করে।

অর্থাৎ বিবিএস ও সরকারের যেকোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে এককভাবে কাজটি অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে সম্পাদন করা। এই মুহূর্তে বিবিএসের উচিত শুমারি-উত্তর যাচাইকাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা—এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে জনমনে আস্থা অর্জন করা। সরকারের উচিত বিবিএসের মতো সরকারি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে বিশেষায়িত দক্ষ জনবল ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। অধিক বিনিয়োগ করা এবং স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা।

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

mainul@du.ac.bd