অমর একুশে গ্রন্থমেলার ৪০ বছরে আমাদের কী অর্জন, তা বিবেচনা করলে আশাবাদের চেয়ে হতাশার চিত্র চোখে পড়ে বেশি।
প্রতিবছর বইমেলায় কীসব বই প্রকাশিত হচ্ছে, এ প্রশ্নটি বারবারই সামনে আসে। দেখা যায়, গড়পড়তা মানের বই–ই সংখ্যায় বেশি, তার মধ্যে নিম্নমানের বইও প্রচুর। এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেই।
বলা যায়, মান নিয়ন্ত্রণের মোট তিনটি পক্ষ—লেখক, প্রকাশক ও আয়োজক বাংলা একাডেমি। দীর্ঘ ৪০ বছরে বইমেলার যে ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার কথা, তা গড়ে ওঠেনি। ধারণা করি, তিনটি পক্ষেরই ব্যর্থতা আছে। আর সেই ব্যর্থতার কারণে বইমেলার শুধু বাণিজ্যিক ভাবমূর্তিই বিকশিত হয়েছে।
প্রতিবছর কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বই বিক্রি হয়। মেলার আগে, এমনকি মেলা চলাকালীন যে কেউ প্রকাশকদের অর্থকড়ি দিয়ে বই প্রকাশ করে ফেলতে পারেন। কেউ কেউ বিজ্ঞাপনের জোরে অনেক বই বিক্রিও করে ফেলেন। অর্থাৎ বইটি পণ্যগত যোগ্যতা অর্জন করলেও এটির অন্তর্নিহিত মূল্য বা মান কেমন, তার কোনো ফিডব্যাক পাওয়া যায় না।
কিন্তু বইমেলাকে সত্যিকারের বইমেলা করতে হলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রতিটি ধাপে মাননিয়ন্ত্রণ জরুরি।
মাননিয়ন্ত্রণের প্রথম পদক্ষেপ পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দিকে অনেক ক্ষেত্রে নজর দেওয়া হয় না। যেহেতু এ জন্য নির্দিষ্ট কোনো পক্ষ নেই, তাই প্রকাশককেই কষ্ট করে ও প্রয়োজনে দুই পয়সা খরচ করে কাজটি করতে হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, কোনো কোনো প্রকাশক এ দায়িত্ব পালন করেন না। এমনকি কোনো কোনো প্রকাশনা সংস্থা প্রুফ দেখার দায়িত্বও কাঁধে চাপাতে চায় না।
অনেক ক্ষেত্রেই বই প্রকাশের আগে সাধারণত লেখক-প্রকাশকের মধ্যে যে কথা হয়, মোটাদাগে তা হচ্ছে, প্রকাশক বলেন, আপনি এত টাকা দেবেন কিংবা ২০০ থেকে ৩০০ কপি বই কিনে নেবেন।
এ জন্য প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার পর করুণ রসিকতা করে কোনো কোনো লেখক বলতে পারেন, ‘আমার বই ২০০ বা ৩০০ কপি বিক্রি হয়ে গেছে।’ এই ডিলিংয়ে সব সময়ই অস্পষ্টতা বিরাজমান। যেমন কত কপি বই মুদ্রিত হবে, সে বিষয়ে কোনো কথা হয় না, যেহেতু কোনো চুক্তিপত্রই সম্পাদিত হয় না।
মেধাস্বত্ব থেকে সম্মানী অর্জনে লেখকেরা সাধারণত উচ্চকিত হন না। কারণ, তাঁদের কেউ কেউ বই প্রকাশ করতে পারলেই খুশি। আর প্রকাশকেরা ভাবেন, বিনিয়োগ না করেই কার্যক্রম চালানো সম্ভব হলে কী দরকার খরচ করার?
কখনো লেখক যদি বলেন, ঠিক আছে রয়্যালটি দেবেন তো। তখন প্রকাশক বলেন, বই বিক্রি হলে অবশ্যই পাবেন। কিন্তু বই বিক্রি হলো কি হলো না, তার কোনো হদিস থাকে না। উপরন্তু প্রকাশকেরা সব সময়ই শুনিয়ে থাকেন, তাঁরা ক্রমাগত লোকসান দিয়েই মেলা চালান।
মেলায় কারও কারও লোকসান যে হয় না, তা নয়। তবে জাঁকজমকপূর্ণ স্টল বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাওয়া এবং তাঁদের গলা টেনে কথা বলার মধ্যে একধরনের বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়।
বই আর পাঁচটি পণ্যের মতো নয়। এর ব্যবহারিক মূল্যই প্রধান, এর প্রকৃত মূল্য ব্যবহারিক মূল্যেরও অধিক। এটি বড় ধরনের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। যেকোনো সম্পদ এবং শ্রমেরই একটি পণ্যমূল্য আছে। সেই মূল্য পরিশোধের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় না বলে বাংলাদেশে লেখক-শিল্পীরা শোষিত হচ্ছেন। কিন্তু এই দিক দেখভাল করার কেউ নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চিত্র আমাদের ভিন্ন ধারণা দেয়।
কোরিয়ায় শিশুরা খেলার ছলে যে ছবি আঁকে, তার জন্যও তারা একটি সম্মানী পেয়ে থাকে। আমেরিকার মতো দেশে বাবার দোকানে কোনো সন্তান দু–চার ঘণ্টার জন্য বসলে, সে তার বাবার কাছ থেকে মজুরি পেয়ে থাকে।
আমাদের দেশে গৃহিণীদের শ্রমের মূল্য যেমন স্বীকৃত নয় (যার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদও থাকে), তেমনিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের স্বীকৃতিদানে কোনো কোনো কর্তৃপক্ষের গরজ লক্ষ্য করা যায় না।
বইমেলার বিষয়ে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে সব লেখাই তো মানসম্মত নয়, কাজেই ঢালাওভাবে সবাই কেন সম্মানী পাবেন? এটা ঠিক ধরে নিলে এ কথাও ঠিক যে মানসম্মত লেখকের সংখ্যাও যথেষ্ট।
চুক্তি সম্পাদন বা স্বাক্ষরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, এটি একটু ব্যাখ্যারও দাবি রাখে। বই প্রকাশের আগে লেখক-প্রকাশকের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন আবশ্যক। কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের সচেতনতার বড় অভাব।
বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ অধিকারের সুরক্ষা বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা (পিএইচডি) করতে গিয়ে পিলে চমকে ওঠা সব তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। যেমন আমাদের অনেক জনপ্রিয় লেখকও অনেক সময় কোনো চুক্তি সম্পাদন করেন না। অথচ এই চুক্তি সম্পাদন অন্য লেখকদের উদ্দীপনা হিসেবে অবদান রাখতে পারে।
এই যে চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপক অনুপস্থিতি, সে বিষয়ে কোনো কর্তৃপক্ষের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। একমাত্র বাংলা একাডেমিই আয়োজক হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারে। অন্তত ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি এর প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। এ বিষয়ে লেখক-প্রকাশককে প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে।
এ দায়িত্ব পালন করতে না চাইলেও সবার ক্ষেত্রে চুক্তির অভিন্ন শর্তগুলো কী হবে, সেটি নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য রেগুলেটরি বডি হিসেবে দায়িত্ব পালন বাংলা একাডেমি ছাড়া আর কে করতে পারে? যদি প্রশ্ন ওঠে লেখকের গুণ বিচার-পরবর্তী শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী চুক্তির শর্তগুলো ভিন্নতর হবে, তা হলেও সেটির একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
এই সার্বিক নীতিমালা নির্ধারণের দায়িত্বটি বাংলা একাডেমিই পালন করতে পারে। উল্লেখ্য যে চুক্তিপত্রবিহীন লেখকদের বই সরকারি ক্রয়ে যেমন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়, তেমনি তাদের বই মেলায় প্রকাশের বিষয়ে ন্যূনতম বিধিনিষেধ হলেও থাকতে পারে।
এই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের হাটবাজারে আর একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে বিভিন্ন বইয়ের পুনর্মুদ্রণ। অনুমতি ছাড়া মুদ্রিত হলে এটিকে বলে ‘পাইরেটেড এডিশন’ বা চোরা সংস্করণ। মেলা উপলক্ষে এ ঘটনা অনেক ঘটে। নীতিমালার অভাব বা তা প্রয়োগে দুর্বলতা থাকলে যা হয়। কপিরাইট আইন অনুযায়ী, লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর অনুমতি না নিয়েই যেকোনো কনটেন্ট পুনমুর্দ্রণ করা যায়।
কিন্তু এটা কি নিশ্চিত যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৬০ বছর পর অর্থাৎ ২০০১ সালের আগে তাঁর কোনো গ্রন্থ অনুমতি ছাড়া পুনর্মুদ্রিত হয়নি? রেপ্রোগ্রাফিক রাইট বা পুনর্মুদ্রণের অধিকার বলে একটা কথা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে রেপ্রোগ্রাফিক রাইট–সংক্রান্ত কোনো সংস্থা নেই বলে প্রকৃত লেখকেরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে।
১৭৯০ সালের আমেরিকার কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইনে চোরা সংস্করণকে উৎসাহিত করা হলেও আমাদের দেশের ২০০০ সালের আইনে তা করা হয়নি। তারপরও আইনকে লেখক-প্রকাশক সবাই বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করেন।
মেধাস্বত্ব থেকে সম্মানী অর্জনে লেখকেরা সাধারণত উচ্চকিত হন না। কারণ, তাঁদের কেউ কেউ বই প্রকাশ করতে পারলেই খুশি। আর প্রকাশকেরা ভাবেন, বিনিয়োগ না করেই কার্যক্রম চালানো সম্ভব হলে কী দরকার খরচ করার?
বইমেলাকে ঘিরে রয়েছে চতুর্মুখী আবেগ। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির আবেগ। বই প্রকাশ করে ‘বুদ্ধিজীবী হওয়ার আবেগ’। সৃজনশীল কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা নিয়ে প্রকাশকদের আবেগ ইত্যাদি।
এসব আবেগেরও মূল্য অনেক। এই আবেগকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তা বিবেকের উচ্ছ্বাসে রূপান্তর করা একান্ত জরুরি।
গোলাম শফিক কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক