কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: মুনাফা, ঝুঁকি ও নৈতিকতার লড়াই

টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আজকের লেখার মূল প্রদায়ক অ্যান্ড্রু চৌ এবং বিলি পেরিগো। প্রতি সপ্তাহে একটি করে লেখা প্রকাশ করা হবে। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সাবালক হয়ে ওঠার যাত্রা’।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণের বিষয়টি খুব উদ্বেগের হলেও অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এআই নিয়ে বড় টেক কোম্পানিগুলোর এই ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে তার পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উদাহরণটাই দেখা যাক। প্রতিশ্রুতি এবং স্বপ্নটা ছিল, আমরা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হব এবং এভাবেই সমাজে আরও সুস্থতা আসবে, ব্যক্তি হিসেবেও আমরা সুখী এবং আরও বেশি আনন্দে থাকব। কিন্তু এক দশক পরেই দেখা গেল, এই শুভ চিন্তায় কোনো সমস্যা না থাকলেও সমস্যা তৈরি হলো তখনই, যখন টেক কোম্পানিগুলো সামাজিক যোগাযোগকে নগদ নারায়ণ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করল।

তারা আমাদের নিউজফিডকে এমনভাবে পরিবেশন করতে শুরু করল, যেন আমরা বেশি সময় স্ক্রিনে কাটাই, ভাইরাল কন্টেন্টগুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো বিজ্ঞাপন। ফলে আসল সামাজিক যোগাযোগ গেল কমে এবং জায়গা করে নিল এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল খবর ও বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা তথ্যের ব্যবসা।

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, বড় টেক কোম্পানিগুলো এআইয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই পথেই হাঁটছে। অ্যালফাবেট (গুগলের মূল কোম্পানি) এবং মাইক্রোসফট—দুজনই এখন তাদের নিজ নিজ সার্চ ইঞ্জিনে এআই যুক্ত করার চেষ্টা করছে। কারণ, সেখানেই বিরাট ব্যবসার সম্ভাবনা।

জেনারেটিভ এআইকে যে সৃষ্টিশীল, উদ্ভাবনী ধারণা তৈরি এবং মানুষের সাহায্যকারী ভূমিকায় ব্যবহার করার কথা ছিল, সেই উদ্দেশ্যকে গৌণ করে, সার্চ ইঞ্জিনে একে ব্যবহার করে কল্পনাতীত বড় মাত্রায় ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট (বায়াসড) তথ্য সরবরাহ করার এবং সামাজিক পর্যায়ে সেই ভুল তথ্যের ক্রমবর্ধমান শাখা–প্রশাখা বিস্তার ও প্রভাব তৈরি করার পথ খুলে দেওয়া হচ্ছে।

সার্চ ইঞ্জিনে জেনারেটিভ এআই যুক্ত করার এই পরিবর্তনটুকু আপাতনিরীহ ও সামান্য মনে হলেও যেসব ব্যবসা বা উদ্যোগ বিজ্ঞাপন বা ব্যবসা-যোগাযোগের জন্য সার্চ ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরশীল—তারা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়বে। বড় টেক কোম্পানিগুলোর চ্যাটবটগুলো সংবাদমাধ্যম বা সাইটগুলো থেকে কন্টেন্ট গোগ্রাসে নিয়ে নেবে এআই দিয়ে তাদের কনটেন্ট তৈরির জন্য, কিন্তু বিনিময়ে মূল কন্টেন্ট নির্মাতারা কিছুই পাবেন না।

এআই দিয়ে চিত্রকর্ম তৈরির ব্যাপারে এখনই এই আপত্তিটা জোরেশোরে উঠেছে। আসলে যে শিল্পীদের চিত্রকর্ম থেকে এআই শিখেছে, তাঁদের মেধা বা সৃষ্টিশীলতার কোনো স্বীকৃতি বা অস্তিত্বই আর থাকছে না ‘টেক্সট টু ইমেজ’–এর আঁকা ছবিগুলোতে।

এআই কোম্পানিগুলো কীভাবে মুনাফার দিকে যাচ্ছে এবং যাবে, সে ব্যাপারটাও আশঙ্কাজনক। উদ্ভাবন থেকে মুনাফার দিকে যাত্রাটা সনাতন সিলিকন ভ্যালি ছকই (প্লেবুক) অনুসরণ করে। ব্যাপারটা শুরু হয়, প্রথমে পণ্য (এ ক্ষেত্রে এআই অ্যাপ্লিকেশন) নামমাত্র বা বিনা মূল্যে বাজারে নামানোর মাধ্যমে। এই আপাত ‘বিনা মূল্যে বিতরণের’ পেছনে ‘ভেনচার ক্যাপিটাল’ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর ভর্তুকি দেয়।

উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও বাড়ানো। এর ফলাফলও হয় একেবারে সনাতনী-ব্যর্থ কোম্পানিগুলো ক্রমাগত অর্থ খোয়াতে খোয়াতে নিঃস্ব হতে থাকে আর হাতে গোনা কিছু সফল কোম্পানি বাজার কুক্ষিগত করে তাদের নিজেদের সুবিধা ও ক্ষমতামাফিক।

সবচেয়ে অগ্রসর এআই গবেষণাগারগুলোতে কিছু মানুষ কাজ করছেন, যাতে ভবিষ্যতের এআই মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মানদণ্ডগুলো মেনে চলে। অনেকটা এমন একটা ঈশ্বর তৈরির চেষ্টা, যিনি শুধু ভালোই করবেন, কোনো খারাপ করবেন না, শাস্তি দেবেন না। সমস্যা হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে যখন এআইয়ের সর্বময় ক্ষমতা তৈরির অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জিততে দিনরাত কাজ করছেন হাজার হাজার প্রকৌশলী-গবেষক, এআইয়ের নৈতিকতা নিয়ে কাজ করছেন মাত্র ৮০ থেকে ১২০ জন।

মাইক্রোসফটের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে এখনো ‘চ্যাটজিপিটি’ বিনা মূল্যে এবং বিনা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা যাচ্ছে। কিন্তু গত বছর এরাই মাসিক ২০ ডলার মূল্যের বিনিময়ে বিশেষ সেবা ‘চ্যাটজিপিটি প্লাস’ বাজারে ছেড়েছে। গুগলে আপনি যখন সার্চ করবেন, তখন সেই বিজ্ঞাপনগুলোই বেশি বেশি আপনার সামনে আসবে, যেগুলোর জন্য কেউ গুগলকে পয়সা দেবে।

বিজ্ঞাপনে ক্লিক যত বেশি, সার্চ ইঞ্জিন আয় করবে ততো বেশি। যখন তারা এআইয়ের তৈরি করা সার্চের ফলাফল আপনাকে সামনে হাজির করবে, তখনো একই ঘটনা ঘটবে। আপনি নিজের অজান্তেই অংশ হয়ে পড়বেন এক পরিকল্পিত বাণিজ্যব্যবস্থার।

বিপদটা হচ্ছে, এআই পরিবেশিত তথ্য নামের যে পণ্যের ওপর আপনি নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন, আপনার জানার বিন্দুমাত্র উপায় থাকবে না সেটা কি সত্য, না একটা নিছক বিজ্ঞাপন, নাকি এআইয়ের স্বকল্পিত বা বিশেষ উদ্দেশ্যে বানানো কিছু।

মুনাফার আকাঙ্ক্ষা যতই নিরাপত্তার বিষয়টাকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে, ততই মানবজাতির জন্য অস্তিত্বের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ‘ওপেনএআই’র মতো এআই কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য এখন এআইকে যত বেশি মানুষের মানবিক গুণাবলি ও চিন্তার দক্ষতার কাছাকাছি নেওয়া যায়, এটাকে বলা হচ্ছে ‘কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা’। অর্থাৎ ক্রমশ এআই মানুষের নির্দেশনার সীমানা অতিক্রম করে নিজে নিজে, স্বাধীনভাবে মানুষের মতোই ভাবার ক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে। এখানেই মানবজাতির অস্তিত্বের সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা।

একটা বহুল প্রচলিত উদাহরণ হচ্ছে, এআইকে যদি নির্দেশ দেওয়া হয় যত বেশিসংখ্যক সম্ভব পেপার ক্লিপ তৈরি করতে, তাহলে সে যেটা করার চেষ্টা করবে, তা হলো তার ক্ষমতায় থাকা সব ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে সারা পৃথিবীতে থাকা সব কার্বন সংগ্রহ করে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসার, এর মধ্যে পৃথিবীর সব জীবিত প্রাণীর শরীরের কার্বনও অন্তর্ভুক্ত! কারণ, তার লক্ষ্য হচ্ছে যত বেশি সম্ভব পেপার ক্লিপ তৈরি করা, অন্য কিছুই সে বিবেচনায় নেবে না।

২০২২ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি এআই গবেষক মনে করেন, এ ধরনের প্রলয়ংকরী ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ১০ শতাংশ কিংবা এরও বেশি।

সবচেয়ে অগ্রসর এআই গবেষণাগারগুলোতে কিছু মানুষ কাজ করছেন, যাতে ভবিষ্যতের এআই মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মানদণ্ডগুলো মেনে চলে। অনেকটা এমন একটা ঈশ্বর তৈরির চেষ্টা, যিনি শুধু ভালোই করবেন, কোনো খারাপ করবেন না, শাস্তি দেবেন না।

সমস্যা হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে যখন এআইয়ের সর্বময় ক্ষমতা তৈরির অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জিততে দিনরাত কাজ করছেন হাজার হাজার প্রকৌশলী-গবেষক, এআইয়ের নৈতিকতা নিয়ে কাজ করছেন মাত্র ৮০ থেকে ১২০ জন।

‘গুগল ডিপ মাইন্ড’র প্রধান নির্বাহী ও সহপ্রতিষ্ঠাতা ডেমিস হাসাবিস বলছেন, ‘অনেকেই এআই নিয়ে কাজ করছেন অনেকটাই পরীক্ষামূলক ভাবে—‘দেখি না কি হয়’ এ রকম। কিন্তু তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন না যে অত্যন্ত বিপজ্জনক জিনিস নিয়ে তারা নাড়াচাড়া করছেন।’

ধরা যাক, বিজ্ঞানীরা সফল হলেন নিশ্চিত করতে যে এআই মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে না। কিন্তু এআই যেভাবে ভবিষ্যতের অর্থনীতির কেন্দ্রিক এবং অপরিহার্য কাঠামোতে পরিণত হচ্ছে, তাতে তাদের মালিক বড় টেক কোম্পানিগুলো হয়ে যাবে সীমাহীন সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী। তারা তখন এই অবকাঠামো ব্যবহারের জন্য যেকোনো মূল্যই শুধু হাঁকতে পারবে না, এমনকি এই ক্ষমতা ভূরাজনৈতিক শত্রুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারও করতে পারবে।

যদিও ‘ওপেনএআই’ বা ‘ডিপ মাইন্ড’–এর কর্তাব্যক্তিরা বলছেন যে তাঁরা এই বিপুল সম্পদ ও ক্ষমতার একটা সমবণ্টন চান, দায়বদ্ধ থাকতে চান তাঁদের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে, কিন্তু তাঁদের কতটুকু বিশ্বাস করা যায়, কিংবা আস্থা রাখা যায় সেই প্রশ্ন জোরেশোরেই আছে।

সিলিকন ভ্যালির অনেক উদ্যোগই দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা বাস্তবে মোটেও ঘটেনি। আমরা সবাই ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে সমানভাবে যুক্ত হইনি মোটেও, মেটাভার্সের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবহার না করলে গরিব থাকার বিলাসিতা করতে হবে’ বলে যাঁরা তামাশা করেছিলেন, তাঁরাই এখন দেউলিয়া হয়ে অনেকে জেলের ভাত খাচ্ছেন, দুনিয়ার অলিগলিতে অগুনতি ব্যর্থ স্টার্টআপ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

যদিও এআই এসব উপসর্গ ও ঊর্ধ্বশ্বাস উন্মাদনা নিয়েই বেড়ে উঠছে, এরপরও এই যাত্রায় এখন পর্যন্ত লক্ষণ ভালো অর্থে ভিন্ন বলেই মনে হচ্ছে। এআইয়ের প্রযুক্তি এর মধ্যেই ব্যবহারকারীদের কাছে কার্যকর ও দরকারি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এবং প্রচণ্ড গতিতে এর কার্যকারিতা বাড়ছে।

গবেষকেরা বলছেন, প্রতি ছয় থেকে দশ মাসে এআই এর ‘কম্পিউটেশনাল’ দক্ষতা দ্বিগুণ হচ্ছে—এই অবিশ্বাস্য গতি ও শক্তিই বর্তমান সময়টাকে বিদ্যুৎ–চমকের মতো একই সঙ্গে মোহময় এবং ভয়ংকর করে তুলেছে।

  • ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ