ডিজিটাল রূপান্তরের কালে কৃষক-শ্রমিকেরা কেন ‘নায়ক’ হতে পারেন না?

এক.

ভালো এবং মন্দ, দরকারি কিংবা বেদরকারি মিলে বাংলাদেশ ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই রূপান্তরগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্র নির্মাণ সময়ের দাবি।

বর্তমানে সারা বিশ্বই ডিজিটাল রূপান্তরের (চতুর্থ শিল্পবিপ্লব) ভেতর দিয়ে যাচ্ছে অতি দ্রুততার সঙ্গে; বাংলাদেশেও অবধারিতভাবে এ ঢেউ লেগেছে। তবে চরিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর যতটা রাজনৈতিক, ততটা উচ্চপর্যায়ে দক্ষতাকেন্দ্রিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের রূপান্তর, শ্রমবাজার রূপান্তর, অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং জীবনমানের বোধগম্য উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিসরে পরিকল্পনাকৃত ও বাস্তবায়নকৃত নয়।

রাষ্ট্রীয় সেবা প্রদানের ধরন, প্রশাসনের প্রকল্প পরিচালনার পদ্ধতি কিংবা সরকারের নাগরিকবান্ধব উদ্যোগের বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াগুলোকে এমন ডিজিটাল রূপান্তর হয়নি—যেখানে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনতোষণ ও তদবিরভিত্তিক প্রশাসন এবং সেবাদানের প্রক্রিয়াকে শতভাগ ‘নিয়মতান্ত্রিক, নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে সে অনুযায়ী কার্যক্রম ও ডেটাভিত্তিক’ পদ্ধতি দিয়ে প্রতিস্থাপনের লক্ষ্য ও চর্চা আছে। বরং অবাক করা বিষয় যে ডিজিটাল রূপান্তর এবং ঘুষ-দুর্নীতি-তদবির এখানে সহাবস্থান করছে। এখানে ঘুষ দিলে, জায়গামতো তদবির করলে, যথাস্থানে স্বজন থাকলে এনআইডি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ট্রেনের টিকিট, বন্দরের সেবা, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সেবা প্রদানের সমুদয় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা যায়। অর্থাৎ সব ধরনের অটোমেশন প্রক্রিয়া বা ডিজিটাল রূপান্তরে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ জিইয়ে রাখা হয়েছে বলে দরকারি এ প্রক্রিয়া কাঙ্ক্ষিত বৈশ্বিক চরিত্র হারিয়েছে।

‘ফাইবার অ্যাট উপজেলা’ ও ‘ফাইবার অ্যাট ইউনিয়ন’ করা হয়েছে দাবি করা হলেও বাংলাদেশের ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ করা যায়নি। এ কারণে ৯৬ শতাংশ ইন্টারনেট গ্রাহক মোবাইল ইন্টারনেটের। বাংলাদেশ এখনো ‘মেশিন টু মেশিন কমিউনিকেশন’ বিকাশ লাভ করেনি। মুঠোফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলোর অতি সীমিত আইওটি থাকলেও ডেডিকেটেড আইওটি (এলটিই, ন্যারো ব্যান্ড, থ্রিজি, টুজি) নেটওয়ার্ক নেই, ব্যাপক ব্যবহারকারী নেই। এই দুটি বিষয় বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের চরিত্র নির্ধারক। শহরের বাইরে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিহীনতায় অর্থবহ ডিজিটাল রুপান্তর নিজেই গতি হারিয়েছে। তারপরও মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি ডিজিটাল সেবা, মোবাইল পেমেন্টের সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ে নাগালে এলেও, মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ও মানের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এবং ডিজিটাল জীবনমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দেশগুলোর তালিকায় তলানিতে। ডিজিটাল রূপান্তরের উদ্ভাবনী শক্তিতে, শিক্ষা-গবেষণার ভিত্তি নির্মাণ ও রূপান্তরে, শিল্পদক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এর আরেকটি তাৎপর্য হচ্ছে, ডিজিটাল রূপান্তরের এই যাত্রায় বাংলাদেশ এখনো উদ্ভাবক ও নির্মাতা নয়, বরং সেবাগ্রহীতাই থেকে গেছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের (জনমিতিক লভ্যাংশ সুবিধা) সুবিধায় থাকা দেশের জন্য এই রূপান্তরের প্রকৃতি ও চরিত্র যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়। কেননা, এই রূপান্তর ব্যাপক অর্থে উচ্চমান কর্ম তৈরিতে অপারগ এবং গতানুগতিক রপ্তানিবাজারের বোধগম্য অর্থনৈতিক রূপান্তরে বৈশ্বিক মানের চেয়ে বেশ ধীরগতির।

অবকাঠামো পরিকল্পনার সময়কাল ও স্থায়িত্ব, খরচের মডেল এবং পরিবেশগত দিক থেকে অটেকসই থেকে যায় বলে একদিকে ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের মান ও নিরাপত্তার রূপান্তর হচ্ছে না, জীবনমানের বোধগম্য উন্নতি হচ্ছে না, অন্যদিকে রূপান্তর চরমভাবে পলিটিক্যালি মোটিভেটেড বলে এর পরিকল্পনায়, নকশায়, বাস্তবায়নে, সংশোধনে, ফিডব্যাক লুপে স্টেক হোল্ডারদের, সাধারণ মানুষের এবং ব্যবহারকারীদের ইনপুট দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। ফলে, ‘ডিজিটাল রূপান্তর’ আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে, কৃষক-শ্রমিকের কাছে একটা ‘ব্ল্যাক বক্স’। এর ভেতরে কী হচ্ছে সাধারণের ধারণা নেই। ফলে, সে এই রূপান্তরের চরিত্র নির্মাণে ভূমিকা রাখতে একেবারেই অপারগ। বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন এই রাজনৈতিকভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া রূপান্তরে নাগরিকদের ‘গ্রহীতা’কেন্দ্রিক অংশগ্রহণ ব্যতীত অন্য কোনো স্টেক বা স্বার্থ নেই। নাগরিক যেন আমাদের ডিজিটাল রূপান্তরের অংশীজন নয়। রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় নাগরিকের অবদান রাখার কোনোই সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সমাজে ও শিক্ষালয়ে বিষয়টি একেবারেই অনালোচিত।

দুই.

সম্পদ ও সেবা ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল রূপান্তর যেনতেন মানের হলেও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট, টেলিফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড়ি পাতা ও নজরদারিতে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে বহুদূর এগিয়েছে। দেশের সর্বত্র ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ কারণে জবাবদিহি বলে এখন আর কিছু নেই। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণে ডিজিটাল রূপান্তর নির্যাতক রূপ নিয়েছে। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যখন-তখন মামলা হয়ে যাচ্ছে যে কারও বিরুদ্ধে। ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ শুধু ২০২১ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তো করেই যাচ্ছে।

২০২৩ সালে শুরু হয়েছে ভিন্নমত ও বাক্‌স্বাধীনতা দমনের নতুন কৌশল। জানুয়ারিতে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের (নজরদারি) মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেনসোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইনসম্মতভাবে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়ি পাতার ব্যবস্থা) চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এ অবস্থায় আমাদের পেশাজীবীরা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রজনতা ‘ডিজিটাল রূপান্তরের ব্ল্যাক বক্স’ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখলেও নির্যাতন ও ভয়ের সংস্কৃতিতে পড়ে সিস্টেম রূপান্তরের ইনপুট প্রদানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এভাবে শুধু কৃষক-শ্রমিক নন, বরং পেশাজীবী ও ছাত্রদেরও প্রশাসনে, সরকারে ও রাষ্ট্রে ‘স্টেকলেস’ বা ভূমিকাহীন করে দেওয়া হচ্ছে। এ যেন নাগরিকের জন্য রাষ্ট্র নয়, বরং রাষ্ট্রের জন্য নাগরিক!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে কৃষক-শ্রমিকের জনযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই কৃষক-শ্রমিক দেশের পলিসি নির্ধারণে আজ গুরুত্বহীন। আজকের ডিজিটাল রূপান্তর এবং বিরাজনৈতিকীকরণ এ প্রক্রিয়ার শক্তিশালী নতুন দুটি মাত্রা, যেখানে চূড়ান্তভাবে কৃষক-শ্রমিকদের শতভাগ দেশহীন করে ফেলা হচ্ছে।

তিন.

‘প্রভাবশালী ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ ও তাঁর অনুসারী নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদেরা ইতিহাস খুঁড়ে তথ্য-প্রমাণ ও চিন্তা হাজির করে বললেন, ইংরেজ আমলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক বিদ্রোহগুলোও জোরদার ও প্রবল ভূমিকা রেখেছে। সেই সময়ের ১১১ বছরের মধ্যে ১১৮টি কৃষক বিদ্রোহের নজির টেনে তাঁরা দেখান, এসব কৃষক বিদ্রোহই একটানা বিদেশি শাসন ও অন্যায়ের বিরোধিতা করে গেছে। রণজিৎ গুহ তাঁর ‘‘পিজান্ট ইনসার্জেনসি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’’ বইয়ে ইতিহাসের নায়ক হিসেবে কৃষকশ্রেণিকে প্রতিষ্ঠা করেন।’ (ইতিহাসের দিশারি রণজিৎ গুহর ‘দেশে ফেরা’, ফারুক ওয়াসিফ, ১৪ ডিসেম্বর, ২০০৯, প্রথম আলো)। নেদারল্যান্ডসে সম্প্রতি কৃষকদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল সিনেট নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকারি জোটকে হারিয়ে দিয়েছে। এমনকি ভারতেও কৃষক বিদ্রোহে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের কৃষক-শ্রমিক কেন আমাদের আধুনিক ইতিহাসের নায়ক হতে পারেন না?

করপোরেট কৃষির প্রথম দিকে দেখানো হয়েছে কম ফলনশীল দেশীয় বীজের জাত খারাপ, অযান্ত্রিক চাষাবাদ খারাপ। বিপরীতে স্টোরেজ সুবিধা, মানসম্পন্ন বীজের সহজ প্রাপ্যতা এবং যান্ত্রিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। এরপর ক্ষুদ্রঋণের প্রসারের পর বলা হয়েছে, সরকারের ভর্তুকি নয়, বরং ঋণ করে চাষাবাদ করো। পরে চালু হলো হাটবাজারে, মাঠে, সড়কে, পরিবহনে রাজনৈতিক ও পুলিশি চাঁদাবাজি। সারে ও বীজের উচ্চ দামে বিপর্যস্ত হয়ে ঋণ ও চাঁদাবাজির পরে যখন উৎপাদনমূল্য বাজারমূল্য থেকে কমে গেল, জবাবদিহিহীন সরকার ও প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হলো না। একদিকে সুশাসন নেই, অন্যদিকে নেই জনপ্রতিনিধিত্ব ও ভোটব্যবস্থা। প্রাকৃতিক উৎস নষ্ট হয়ে পুষ্টিদারিদ্র্যের সঙ্গে শুরু হয়েছে জলবায়ু-দারিদ্র্য, জ্বালানি-দারিদ্র্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতির নতুন দারিদ্র্য। সব মিলে আমাদের কৃষকের মনোবল ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ক্ষুধায়, শ্রমে ও ভয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রাজনৈতিক সত্তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা পলিটিক্যাল এজেন্সিহীন।

ফলে, আইএমএফের পরামর্শে সরকার যখন ডিজেলের দাম এক অর্থবছরে ৪২ থেকে ৬৫ শতাংশ বাড়ায়, দুবার সারের দাম বাড়ায়, যখন কৃষিভর্তুকি মূল্যস্ফীতির পরে জিডিপির অনুপাতে ব্যাপক কমে, ধনীর আয়কর না বাড়িয়ে যখন গণভ্যাট বাড়ে, স্বাস্থ্যব্যয়ে কৃষক-শ্রমিক দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যায়, ধানসহ গুরুত্বপূর্ণ ফসলের উৎপাদনমূল্য বাজারমূল্য থেকে কম হয়, তখন আমাদের কৃষকেরা কোনো অলৌকিক কারণে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ করতে পারেন না; বরং ব্যক্তিকৃষককে লোকসানের ফসল রাস্তায় ফেলে, রাস্তায় দুধ ঢেলে, এমনকি পাকা ধানে আগুন লাগাতেও দেখা গেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে কৃষক-শ্রমিকের জনযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই কৃষক-শ্রমিক দেশের পলিসি নির্ধারণে আজ গুরুত্বহীন। আজকের ডিজিটাল রূপান্তর এবং বিরাজনৈতিকীকরণ এ প্রক্রিয়ার শক্তিশালী নতুন দুটি মাত্রা, যেখানে চূড়ান্তভাবে কৃষক-শ্রমিকদের শতভাগ দেশহীন করে ফেলা হচ্ছে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। faiz.taiyeb@gmail.com