পেশোয়ারের রক্তগঙ্গা বহু প্রশ্নের মুখে ফেলল পাকিস্তানকে

পাকিস্তানে পেশোয়ারে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বিধ্বস্ত পুলিশ লাইন মসজিদ।
ছবি: এএফপি

পেশোয়ারে পুলিশ লাইন মসজিদে হামলায় মৃতের সংখ্যা এখন ৯২। পাকিস্তান আজীবন ভারতের দিক থেকে হামলা রোখার প্রস্তুতি নিয়েছে। যেভাবে ভারত নিজেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টায় থাকে পাকিস্তান ও চীনের দিক থেকে। এটাই গতানুগতিক ‘প্রতিরক্ষা’ ধারণা। কিন্তু এ রকম ধারণার নতুন সংস্করণ দরকার এখন।

একটা দেশ কেবল সীমান্তের বাইরে থেকেই আক্রান্ত হয় না। ভেতর থেকেও চরমভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়তে পারে। নিরাপত্তাহীনতার এই দ্বিতীয় ধরনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। অথচ তার প্রতিদান দিতে হচ্ছে নির্মমভাবে এবং তার জন্য রাষ্ট্রের কেউ জবাবদিহি করছে না। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা তা-ই বলছে।

আরও বহু অস্ত্রপাতির পাশাপাশি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে এখন অন্তত ১৬৫টি পারমাণবিক বোমাও রয়েছে। কিন্তু এসব অস্ত্র জনগণ তো দূরের কথা, খোদ নিরাপত্তা বাহিনীকেও সুরক্ষা দিচ্ছে না। গত এক বছর দেশটিতে বিভিন্ন বাহিনীর প্রচুর জওয়ান খুন হলেন, দেশের ভেতরই গ্রাম-শহরে—নিজেদের ‘বিদ্রোহী’ নাগরিকদের হাতে। গতকালের হামলা ঘটেছে একটি প্রদেশের রাজধানীতে। তার মানে, প্রান্তিক অঞ্চলের সাধারণ মানুষ অনেকাংশে অরক্ষিত। এমনকি মসজিদেও।

পাকিস্তানের সর্বশেষ হত্যাকাণ্ড যদি কোনো বিদেশি গোলায় হতো, তাহলে এতক্ষণে দেশজুড়ে কী প্রতিক্রিয়া হতো, তা কল্পনা করা কঠিন নয়। কিন্তু এখন শোক-দুঃখ-ক্ষোভ সব নীরবে হজম করতে হবে। তার মানে, ‘শত্রু’-‘মিত্রে’র এত দিনকার প্রচলিত সংজ্ঞাটা কাজে লাগছে কমই। এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে?

হামলার পর সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী

এ রকম প্রশ্ন উঠতে পারে যে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অবকাঠামো পাকিস্তানের চলতি অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে রাজি হবে কি? নাকি ঔপনিবেশিক ধাঁচের প্রতিরক্ষা-চিন্তা ও প্রতিরক্ষা-কাঠামোতেই থেকে যাব আমরা? মিসাইল, ট্যাংক ইত্যাদি যে নতুন ধাঁচের নিরাপত্তাহুমকি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়—সেই সত্য বুঝতে দুঃখজনকভাবে আমাদের হয়তো আরও বহুকাল অপেক্ষা করতে হবে।

ক্রমাগত সহকর্মীদের লাশের খাটিয়া বয়ে বেড়ানো কোনো দেশের সেনা কর্মকর্তাদের জন্য গৌরবের কিছু নয়। রাজনীতিবিদদেরও কাজ নয় কেবল নিহত নিজ নাগরিকদের জানাজা পড়ে বেড়ানো। পাকিস্তানে ইদানীং সেটাই ঘটছে। সর্বশেষ নির্মম ও শোকাবহ অভিজ্ঞতা থেকে তাদের বাহিনীগুলোর জন্য বিপুল শিক্ষা আছে। সাত দশকের বেশি সময় ধরে এসব বাহিনীর নেতৃত্ব কাদের মদদ দিয়েছে এবং কাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়েছে, তার নির্মোহ তদন্ত শেষে পাকিস্তানের জনগণ কি প্রকৃত সত্যটা কোনো দিন জানতে পারবে? বছরের পর বছর ‘প্রতিরক্ষা বাজেট’-এর নামে বিলিয়ন বিলিয়ন রুপি কারা কেন কীভাবে খরচ করল এবং করছে, জনগণের তরফ থেকে সেটা জানা জরুরি। যদিও এ রকম জিজ্ঞাসার রাজনীতি যাতে গড়ে না ওঠে, সেই চেষ্টা সেখানে সব সময় ছিল এবং আছে।

পাকিস্তানের জনগণ এ মুহূর্তে দুইভাবে আক্রান্ত। একদিকে বর্তমান ও বিগত শাসকদের কুশাসনের সম্মিলিত ফল এবং অন্যদিকে টিটিপির বোমা-বারুদ থেকে। দেশটি নতুন করে ভয়াবহ অবস্থায় পড়ল।

গতকালের হামলাস্থল পেশোয়ার কাবুলের নিকটবর্তী। কাবুল থেকে পেশোয়ারের দূরত্ব ১৮০ মাইলের মতো হলেও কালকের হামলা জানিয়ে দিচ্ছে, এই দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে, যা দুই দেশের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসে গভীর চিড় ধরাবে। যদিও পাকিস্তানকে গতকালের হামলার উৎস প্রথমত নিজ দেশেই খোঁজা দরকার। কিন্তু অনেক রাজনীতিবিদ তদন্তের আগেই কাবুলের দিকেও আঙুল উঁচু করতে শুরু করেছেন। এ রকম অনুমানের কারণ হলো, হামলার দায়িত্ব স্বীকারকারীরা বলছে, এটা তারা ঘটিয়েছে তেহরিক–ই–তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতা ওমর খালিদ খোরাসানিকে হত্যার বদলা হিসেবে।

গত বছর ৭ আগস্ট ওমর খালিদকে আফগানিস্তানের পাকতিয়ায় হত্যা করা হয়, যার জন্য পাকিস্তান নিযুক্ত গোয়েন্দাদের সন্দেহ করছিলেন টিটিপির কর্মীরা। মনে হচ্ছে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানজুড়ে পাল্টাপাল্টি হামলার এই দুষ্টচক্রগুলো শিগগিরই থামবে না। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উভয় দেশের মানুষ।

হামলার পর পুলিশ লাইন মসজিদ। পেশোয়ার।

গত বছর থেকে পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা জনগণকে ধারণা দিয়েছে, আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্তটি তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়ে গেল। এ রকম ধারণা একধরনের নীরব উল্লাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু গত ছয় মাসের অভিজ্ঞতা একদম উল্টো। এই সীমান্ত সন্নিহিত এলাকাই তাদের জন্য এখন মরণ-উপত্যকা হয়ে উঠেছে।
গতকাল হামলায় মৃত ৯২ জনের ৮৫ জনই একটি বাহিনীর সদস্য। এ রকম জনসম্পদ তৈরিতে জনগণের বিপুল বিনিয়োগ থাকে। এ রকম বিনিয়োগের সর্বশেষ করুণ পরিণতি পাকিস্তানের আফগান নীতির ময়নাতদন্ত দাবি করছে।

পাকিস্তানের শাসকেরা আফগানিস্তানের যুদ্ধে বিগত দশকগুলোতে বিপুল ভূমিকা রেখেছে। প্রথমে রাশিয়া এবং পরে ন্যাটো আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রের বড় অংশই এখন পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে।

দেশটির জন্য আগামী দিনগুলো প্রকৃতই বহুভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। রুপির দাম হু হু করে পড়ছে। পেশোয়ার হামলার আগের দিন পেট্রল-ডিজেলের দাম লিটারে ৩৫ রুপি করে বাড়ানো হয়েছে। আইএমএফ টিম আসার আগেই দেশটির সরকার এভাবে জনগণের ওপর অর্থনৈতিক অনাচারের যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, পেশোয়ার হামলা যাঁরাই করে থাকুন, যোদ্ধা হিসেবে তাঁদের সময়জ্ঞান খুব উঁচু দরের। যেকোনো হামলাকারী সাধারণত প্রতিপক্ষের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পেশোয়ার হামলাও তা-ই ছিল।

পাকিস্তানের জনগণ এ মুহূর্তে দুইভাবে আক্রান্ত। একদিকে বর্তমান ও বিগত শাসকদের কুশাসনের সম্মিলিত ফল এবং অন্যদিকে টিটিপির বোমা-বারুদ থেকে।
দেশটি নতুন করে ভয়াবহ অবস্থায় পড়ল।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ইতিহাস গবেষক