মতামত

জনগণের চাওয়া, আওয়ামী লীগের উল্টো হাওয়া

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে আওয়ামী লীগ অফিসে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে আওয়ামী লীগ অফিসে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ অফিসে গেলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফুল দিয়ে বরণ করেছেন।

কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে সম্ভবত পিটার হাসের এই প্রথম যাওয়া। অন্য দলের অফিসে তিনি গেলে হয়তো আওয়ামী লীগের নেতারা রই রই করে উঠতেন। বলতেন, দলীয় অফিসে গিয়ে রাষ্ট্রদূত ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছেন।

রাজনীতিকেরা সবকিছু বিচার করেন সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। যদি বিদেশি দূতের কথাটি নিজের পক্ষে যায়, উল্লাস প্রকাশ করেন। আর বিপক্ষে গেলে তাঁদের সৌজন্যবোধ, নিরপেক্ষতা ও এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যখন একটি দেশের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকায় এসে কোনো দলকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ দিলেন, তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও জেনেভা কনভেনশন নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।

আওয়ামী লীগ অফিসে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উষ্ণ আতিথেয়তা দেখে মনে একটি প্রশ্ন জাগল। আমরা কি এ রকম একটি দৃশ্যের কল্পনা করতে পারি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির অফিসে গিয়েছেন এবং সেখানে বিএনপির মহাসচিব ফুল দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিংবা বিএনপির মহাসচিব আওয়ামী লীগের অফিসে গিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন। এরপর তাঁরা একে অপরের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আসুন, নির্বাচন নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে, সেটি আমরা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করি।’

আমরা সেই রকম রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে পারিনি বলে ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় নিয়ে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করার বা নাক গলানোর সুযোগ পাচ্ছেন। বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, এবার বিএনপির ওপরই মার্কিন ভিসা নীতি কার্যকর হবে। বিএনপি সন্ত্রাস করলে অবশ্যই তাদের ওপর এটা প্রয়োগ হবে। কিন্তু একইভাবে যাঁরা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেছেন, ক্যাম্পাসে গেলেই গণ অধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হকের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তঁারাও তো ভিসা নীতির আওতায় আসবেন। 

সাধারণত এক দেশের রাষ্ট্রদূত অন্য দেশের সরকার ও রাজনীতিকদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ, ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা ইত্যাদি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দেশটির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন, তার একমাত্র অ্যাজেন্ডা আগামী নির্বাচন। কয়েক দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধিও বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে গেছেন। তাঁরা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবেন কি না, সেটা যাচাই করতে দফায় দফায় প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন।

২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আর ২০০৮ সালে তো দলটি রীতিমতো ভোটবিপ্লব করে ফেলেছিল, যার প্রধান শক্তি ছিল তরুণ প্রজন্ম। এরপরই আওয়ামী লীগের উল্টো যাত্রা শুরু হয়। ২০০৮ সালে যে নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছিল, তারা ও তাদের পরের প্রজন্ম পরের দুটি নির্বাচনে ভোটই দিতে পারেনি। ফলে জনগণের চাওয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

সোজা কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনটি আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। কয়েকজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করারও দাবি জানিয়েছেন। কাছাকাছি সময়ে ভারতেও সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেই নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভেতরে যতই তোলপাড় হোক না, বাইরের কেউ কথা বলতে পারছেন না। তারা একটি নির্বাচনী কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সেই কাঠামো বদলাবে না। আমরা সেই কাঠামো তৈরি করতে পারিনি। 

আমাদের নির্বাচন নিয়ে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, কথা বলছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া। ভারতও মুখ খুলেছে। বৃহস্পতিবার দিল্লিতে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে চাইবেন, ভোট সেভাবে হবে। ভারত চায় নির্বাচনটি পরিকল্পনামাফিক হোক, সহিংসতামুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হোক।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমেরিকা ও তাঁর দলের চাওয়া একই—অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের বক্তব্যে আওয়ামী লীগ কোনো চাপ অনুভব করছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হয় ওবায়দুল কাদেরের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কেন চাপ অনুভব করবে? সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন আমাদের অঙ্গীকার। যদি বলেন, বিবেকের চাপ অনুভব করছি।’

ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিদেশিরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে। জাতীয় পার্টি থেকে শুরু করে ক্ষীয়মাণ বাম ও  ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী দলগুলোও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তাহলে সমস্যাটি কোথায়? বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এত ঝগড়াবিবাদ, মারামারি-কাটাকাটি হয় না।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, পিটার হাসের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার মতো বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়নি। ওবায়দুল কাদের সাহেব অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি নিশ্চয়ই জানেন, কূটনীতিকেরা কী ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা তো এক দলের পক্ষ হয়ে আরেক দলের কাছে দাবিনামা পেশ করবেন না। তাঁরা উভয় পক্ষের কথা শুনবেন। বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন, এরপর নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বার্তা পাঠাবেন। ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকট ও ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে মার্কিন দূতাবাস যেসব বার্তা পাঠিয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে উইকিলিকসে বাংলাদেশ বইয়ে (সংকলন, সম্পাদনা ও অনুবাদ মশিউল আলম, প্রথমা প্রকাশন)।

বাংলাদেশের রাজনীতিকদের বিদেশিরা কী চোখে দেখেন, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই বই। সে সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব দাবি তুলেছিলেন, আজ বিএনপির নেতারা সেসব দাবিই সামনে নিয়ে আসছেন।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমেরিকা ও আওয়ামী লীগের চাওয়া একই। কিন্তু জনগণের চাওয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে বিরাট দূরত্ব ঘটে গেছে, সেটা কি দলের নেতারা বুঝতে পারছেন? সম্প্রতি ঢাকা-১৭ ও চট্টগ্রাম-১০-এর উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১২ শতাংশের কম। এর মাধ্যমে জনগণের বৃহত্তর অংশ আওয়ামী লীগের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। 

আওয়ামী লীগের চাওয়ার সঙ্গে জনগণের চাওয়ার উত্তম মেলবন্ধন ঘটেছিল ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশের মানুষ ছাপ্পর ফেড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরে। ফলে খন্দকার মোশতাকসহ দলের কয়েকজন বিতর্কিত নেতাকে জবরদস্তি করে জিতিয়ে আনতে হয়েছিল। নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর জনগণের চাওয়ার সঙ্গে ফের আওয়ামী লীগের মেলবন্ধন হয় ১৯৯৬ সালে।

২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আর ২০০৮ সালে তো দলটি রীতিমতো ভোটবিপ্লব করে ফেলেছিল, যার প্রধান শক্তি ছিল তরুণ প্রজন্ম। এরপরই আওয়ামী লীগের উল্টো যাত্রা শুরু হয়। ২০০৮ সালে যে নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছিল, তারা ও তাদের পরের প্রজন্ম পরের দুটি নির্বাচনে ভোটই দিতে পারেনি। ফলে জনগণের চাওয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব বাড়তে থাকে।

নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের উৎকণ্ঠার কারণ বিএনপি বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নয়, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়া। তারাই মোট ভোটারের ৭০ শতাংশ।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com