গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেছে। ফলাফল অনেককে চমকে দিয়েছে। গাজীপুরের সাবেক মেয়রের মা কার্যত ছেলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করে জিতে গেছেন। এই ফলাফল নিয়ে নানা বিশ্লেষণ হচ্ছে, যদিও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে নিজেদের মধ্যেই।
তবে বাকি যে চারটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেগুলো সম্ভবত নিষ্প্রভ হবে। কারণ, এই নির্বাচনগুলো প্রায় প্রতিযোগিতাশূন্য বা যে দল শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, তারা এসব নির্বাচন বর্জন করেছে। কাজেই প্রায় সব নির্বাচনে নিজেদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে, হবে; বিশেষ করে মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে। যদি কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, তা হচ্ছে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদগুলোয়।
এসব নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিবেশ নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়া বা সংকট তৈরির তেমন আশঙ্কা না থাকলেও নির্বাচন আয়োজকদের জন্য তা বড় ধরনের পরীক্ষা। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন এবং মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত সরকারি আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। নির্বাচন কমিশনের বড় পরীক্ষা তাদের ব্যবস্থাপনা, এর মধ্যে অভিযোগের নিষ্পত্তি ও ভোটারদের নিরাপত্তা, ভোটের নিশ্চয়তা প্রদানে আশ্বস্ত করার বিষয়।
নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এসব স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আইন প্রয়োগে প্রথম থেকেই কঠোর হওয়া এবং যেখানে প্রয়োজন আইনকে আরও স্বচ্ছ করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে
আমি আগেও বলেছি, এসব নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি বা পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনার সুযোগও নেই। কারণ, সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নয়। তেমনি ‘পেপার ব্যালটের’ ক্ষেত্রে যে ব্যবস্থাপনাগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এই নির্বাচনগুলোয় তা–ও নেই। এটা বেশ জটিল কাজ। সিটি নির্বাচনগুলো হচ্ছে ইভিএমের মাধ্যমে, জাতীয় নির্বাচন হবে পেপার ব্যালটের মাধ্যমে।
যা–ই হোক, অতীতে এই নির্বাচন কমিশনের অধীন যেসব নির্বাচন হয়েছে, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ আসনের উপনির্বাচন এবং চট্টগ্রাম নির্বাচনে যে শিথিলতা ও আইন প্রয়োগে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়তা দেখা গিয়েছিল, গাজীপুরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বাকিগুলোতেও হবে বলে মনে হয় না। গাজীপুরের নির্বাচনে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি দল–সমর্থিত প্রার্থী আজিজুর রহমানের প্রার্থিতা ‘ত্রাস সৃষ্টি ও ভয়ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার অভিযোগে’ বাতিল করা হয়েছে। এর জন্য নির্বাচন কমিশন অভিনন্দন পেতে পারে।
২০০৭ সালে এ বিধান কার্যকর হওয়ার পর এই প্রথম এর প্রয়োগ হয়েছে। ওই প্রার্থী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, নৌকার ভোটার ছাড়া আর কাউকে কেন্দ্রে আসতে দেবেন না। খুবই মারাত্মক হুমকি! তবে এ ধরনের হুমকি নতুন কিছু নয়, বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বিভিন্ন সময় এ ধরনের হুমকির অভিযোগ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও কোনো কমিশন আমলে নেয়নি।
গাজীপুর নির্বাচনের আগের রাতে বাংলাদেশের নির্বাচনসংক্রান্ত উদ্বেগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষিত হয়। গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পেছনে এই ভিসা নীতি কাজ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। এই নীতিমালা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, নিষেধাজ্ঞার চেয়ে এটা অধিক কার্যকর হতে পারে এবং আমাদের দেশের জন্য তা লজ্জাজনক।
এই ভিসা নীতি নিয়ে সরকারি বা বিরোধী—কোনো পক্ষ থেকেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। দুই দলই প্রাথমিকভাবে পরস্পরের দিকে এর প্রভাব বেশি পড়ার কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধাদানকারীদের জন্য একধরনের সতর্কবার্তা। ভোট জালিয়াতি থেকে শুরু করে ভোটের প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারী যে কেউ এই নীতির আওতায় পড়তে পারেন।
শুধু তা–ই নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কলুষিত করার প্রয়াসে অতীতে যাঁরা লিপ্ত ছিলেন বা ভবিষ্যতেও থাকবেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও এই ভিসা নীতি কার্যকর থাকবে। মানে অতীত কর্মকাণ্ডের জন্যও কেউ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তবে তাঁদের চিহ্নিত করার কাজটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ হবে না। এই ভিসা নীতি যেভাবেই প্রয়োগ হোক বা প্রয়োগ করার হুমকি হোক, কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা এবং নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের টার্গেট হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
আমি আগের লেখা ও বক্তব্যগুলোয় বলে আসছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এযাবৎ অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হতে যাচ্ছে। এর ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব সর্বপ্রথম নির্বাচন কমিশন ও কর্মকর্তাদের ওপরে বর্তাবে। অতীতে দায়িত্ব না নিয়ে কমিশন পার পেলেও ভবিষ্যতে তা না–ও হতে পারে।
কাজেই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে এসব স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আইন প্রয়োগে প্রথম থেকেই কঠোর হওয়া এবং যেখানে প্রয়োজন আইনকে আরও স্বচ্ছ করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। সেই সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে কীভাবে নির্বাচন কমিশনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়, সংশ্লিষ্ট শরিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com