নারীর প্রতি বৈষম্য কমাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ুক

বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবারের মতো এ বছর ৮ মার্চ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি খাত হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। নারীর ক্ষমতায়নে প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশকে এগিয়ে যেতে হলে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। সেটা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। তবে সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে নারীরা কর্মক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারছেন না। সরকারি হিসাবমতে কর্মক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রায় ১৫ শতাংশ নারী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কাজ করেন, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অবস্থান শতকরা ১ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) একটি জরিপে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে পড়াশোনা করছেন, এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে প্রোগ্রামিংকে পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহী।

অথচ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিত বিষয়ে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ প্রতিবছর বাড়ছে ১৭ শতাংশ হারে, যেখানে অন্যান্য খাতে এ বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ।

বর্তমান সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তবে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই

শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বেই প্রকৌশল ও প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। আমাদের পাবলিক পরীক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফলে নারী শিক্ষার্থীদের আধিপত্য দেখতে পাই। তাহলে কেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে নারীরা পিছিয়ে থাকবেন? মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারার কারণেই সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।

জিএসএমএ, লন্ডন কর্তৃক প্রকাশিত দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৬ শতাংশ পুরুষের মুঠোফোন আছে। অন্যদিকে মুঠোফোন ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা ৬১ শতাংশ। মানে এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য ২৯ শতাংশ। মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য আরও প্রকট, প্রায় ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, মা-বাবা তাঁর পুত্রসন্তানকে প্রয়োজনে মুঠোফোন বা ল্যাপটপ কিনে দিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু কন্যাসন্তানের একটি নিজস্ব ডিভাইস পেতে সচ্ছল পরিবারেও অনেক বেগ পেতে হয়।

যেসব পরিবারে একাধিক সদস্য একটি মুঠোফোন ব্যবহার করেন, সে ক্ষেত্রে ডিভাইসটির মালিকানা থাকে বাড়ির পুরুষ সদস্যের। পরিবারের নারী সদস্যরা প্রয়োজনে ব্যবহার করেন বাবা, স্বামী, ভাই বা পুত্রসন্তানের মুঠোফোন। করোনার সময় অনেক নারী শিক্ষার্থী এ কারণে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারেননি। ভাই-বোন দুজন শিক্ষার্থী থাকলে ভাইটিই অনলাইন ক্লাসে যুক্ত থাকার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের বাবা-মায়েরা পুত্রসন্তানের পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সঞ্চয় করেন আর কন্যাসন্তানের ‘বিয়ে দেওয়া’র জন্য থাকে আলাদা সঞ্চয়!

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ২০২০ সালের উইমেনস রিপোর্ট অনলাইনের তথ্যমতে, অনলাইনে আমাদের দেশের শতকরা ৭৩ ভাগ নারী সহিংসতার শিকার হন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী তথাকথিত সামাজিক লোকলজ্জার কারণে কোনো ধরনের কেস রিপোর্ট করেন না এবং ৬৩ শতাংশ নারী জানেনই না যে অনলাইনে সহিংসতার শিকার হলে সাহায্যের জন্য কোথায় যেতে হবে, কীভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও অনলাইনে বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম মেসেঞ্জারে। ফলে অনেক মা-বাবা তাঁর কন্যাসন্তানকে ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি দিতে দ্বিধা বোধ করেন। কিন্তু মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা তো সমাধান নয়। ‘ডিজিটাল লিটারেসি’ সবার জন্যই বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি জায়গায় সুলভ মূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া প্রয়োজন। রাজধানী শহরে বসে আমরা যে গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করি, ঠিক একই গতি আমাদের হাওরাঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চলসহ সারা দেশে নিশ্চিত করতে হবে।

ডিজিটাল প্রযুক্তিতে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অফিসের ধরাবাঁধা সময়ের বাইরে বাড়িতে বসেও অনেক কাজ করা সম্ভব। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ঘরে বসে কাজ করেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারেন। ই-কমার্স, এফ-কমার্স, এম-কমার্সের আওতায় আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরাও এখন স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

বর্তমান সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তবে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতে নারীদের সংখ্যা কম হওয়ার অন্যতম কারণ, আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা। এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয় কঠিন বিষয় হিসেবে, আর যা কিছু কঠিন, তা তো নারীদের জন্য নয়! টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ছেলেদের বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। অথচ বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার এডা লাভলেস ছিলেন একজন নারী। প্রথম কম্পাইলার নিয়ে কাজ করা গ্রেস হপার তৈরি করেন প্রোগ্রামিং ভাষা কোবল (সিওবিওএল)।

আশার কথা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গসমতা অর্জনে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে বাংলাদেশ (জেনেভাভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম রিপোর্ট ২০২১ অনুযায়ী)। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ৭৬তম, শ্রীলঙ্কা ১১০তম, মালদ্বীপ ১১৭তম, ভুটান ১২৬তম, ভারত ১৩৫তম, পাকিস্তান ১৪৫তম ও আফগানিস্তান ১৪৬তম অবস্থানে আছে।

বর্তমান সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তবে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি নারীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অবস্থান করে নিতে হবে। আত্মবিশ্বাস, নিজস্ব দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত অনুশীলনের মাধ্যমে নারীরা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তাঁদের সামাজিক ও লিঙ্গসংক্রান্ত বাধা পেরিয়ে নিজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন এবং দেশের অর্থনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন।

  • ড. লাফিফা জামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক