চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন সাতজন। তাঁরা পার্টির পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ তাঁরা। এই কমিটিকে অতীত চীনা সাম্রাজ্যে সম্রাটের পরামর্শক পরিষদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে ওয়াং হুনিং চীনের মানুষের মুখে মুখে ফেরা নাম। চীনা নেটিজেনরা তাঁকে ডাকেন ‘গুওশি’। এই নামের অর্থ ‘রাষ্ট্রের শিক্ষক’।
ওয়াং হুনিং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান চিন্তাবিদ। ১৯৯০–এর দশক থেকে চীনের পার্টির তিনজন সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক আদর্শ তৈরি হয়েছে এই ব্যক্তির মাথা থেকে। এক হিসাবে বর্তমান চীন যাঁদের ভাবনা অনুসারে গড়ে উঠেছে, হুনিং তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে তিনি চীনা জনগণের রাজনৈতিক পরামর্শক সম্মেলন (সিপিপিসিসি) নামে পার্টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
ওয়াং হুনিং রাজনীতি করেননি আগে। ছিলেন একজন একাডেমিক। বিখ্যাত ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক। এমন গুরুত্বপূর্ণ পদ, অথচ আগে তিনি এমনকি কোনো প্রদেশ বা শহরের প্রশাসন বা পার্টির কোনো পদেও ছিলেন না।
১৯৮০-এর দশক থেকে হুনিংয়ের যাত্রা শুরু। ২০০২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় নীতি–গবেষণা দপ্তরের প্রধান ছিলেন। এই দপ্তর থেকে পার্টির মতাদর্শ ও তাত্ত্বিক নথিপত্রের খসড়া তৈরি হয়। এই সময় চীন বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করা শুরু করে। ১৯৮৬ সালে হুনিং এক প্রতিবেদন লেখেন। পার্টির নীতিনির্ধারক মহলে তা নিয়ে তর্ক হয়। সেই সময় হুনিং তত্ত্ব দেন যে চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশ পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের আদলে চলা অবাস্তব ও ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বাজার এখানে চলতে হবে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। শেষ পর্যন্ত হুনিংয়ের ধারণা দিয়েই চীন আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
তিন চীনা প্রেসিডেন্টের দেশ চালানোর মূল স্লোগান তৈরি করে দিয়েছেন হুনিং। জিয়াং জেমিনের ‘তিন উন্নয়ন’, হু জিন তাওয়ের ‘উন্নয়নে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ আর সর্বশেষ সি চিন পিংয়ের ‘নতুন যুগ’। এই স্লোগানগুলো যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে, তা অনুসরণ করলে আজকের চীনকে বোঝা যাবে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম হুনিংকে নিয়ে খুব বেকায়দায় আছে। তিনি হাল আমলের ম্যাকিয়াভেলি। এক কমিউনিস্ট দেশের স্বপ্ন বোনেন তিনি। চীনের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার পেছনের রহস্যময় শক্তিশালী মাথা। পর্দার আড়াল থেকে তিনিই চীনকে চালান। সি চিন পিংয়ের ভাবনায় মার্ক্সীয় বৈশিষ্ট্যগুলো হুনিংয়ের মাথা থেকেই আসে। আরও একটা কথা আছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তা নিয়ে খুব অস্বস্তিতে থাকে। আমেরিকা চীনকে বুঝতে পারে কি না, তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু চীনে একজন মানুষ আছেন, যিনি আমেরিকাকে বোঝেন। তিনি ওয়াং হুনিং।
সম্পদ আর ক্ষমতার বিনিময়ে আমেরিকা তার প্রাণ বিক্রি করে দিয়েছে। সেই প্রাণ হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ঐতিহ্য আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবার। আমেরিকা শক্তিশালী কিন্তু তার প্রাণশক্তি ক্ষীণ। এখানে মানুষ স্বাধীন হওয়ার ছলে নিঃসঙ্গ। এ দেশ ধনী কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু।
১৯৮৮ সালে, ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াং হুনিং আমেরিকা যান। তখন আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন শীতল যুদ্ধ চলছে। ওয়াংকে নিমন্ত্রণ করে আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন ছয় মাসের এক একাডেমিক ভিজিটে। আমেরিকার ডজনখানেক শহরে গেলেন তিনি। কোকাকোলা সদর দপ্তরে গেছেন। জর্জ বুশ আর মাইকেল ডুকাকিসের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যক্ষ করেছেন। লাইব্রেরিগুলো ঘুরে বেড়িয়েছেন, নাসায় গেছেন, গেছেন জাদুঘরগুলোতে।
আমেরিকার রাজপথ, অট্টালিকা, যন্ত্রনির্ভর দ্রুত ছুটে চলা জীবনের গভীর গোপনে হুনিং এক ‘সংকটের চোরাস্রোত’ দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে সম্পদ আর ক্ষমতার বিনিময়ে আমেরিকা তার প্রাণ বিক্রি করে দিয়েছে। সেই প্রাণ হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ঐতিহ্য আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবার। আমেরিকা শক্তিশালী কিন্তু তার প্রাণশক্তি ক্ষীণ। এখানে মানুষ স্বাধীন হওয়ার ছলে নিঃসঙ্গ। এ দেশ ধনী কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু।
সমাজকে বুঝতে চাইলে সবচেয়ে কাজের জিনিস বাজার আর বই। ২০২১ সালে আমেরিকার ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা লাগল। চীনে তখন আউট অব প্রিন্ট একটা বই খুঁজতে লাগল সবাই। পুরোনো বই বিক্রির সাইট কংফুজি সেই বইয়ের এক কপি বিক্রি করল তিন হাজার ডলারে। ইন্টারনেটে বইয়ের স্ক্যান করা পিডিএফ কপিতে সয়লাব হয়ে গেল।
গণতন্ত্রের মডেল আমেরিকায় যে এমন দাঙ্গা লাগতে পারে, তা কে ভেবেছে আগে? এই দাঙ্গা চীনাদের মধ্যে আমেরিকাকে ভেতর থেকে বুঝতে আগ্রহী করে তোলে। পশ্চিমাদের বয়ানে তাঁদের আস্থা কম। একজন চীনা মানুষের লেখায় তাঁদের আস্থা বেশি। সেই মানুষ হচ্ছেন ওয়াং হুনিং। আর বইটা তাঁর আমেরিকা থেকে ফিরে লেখা ভ্রমণপঞ্জি ‘আমেরিকার বিরুদ্ধে আমেরিকা’। মজার ব্যাপার, এত আলোচিত বইটির কোনো ইংরেজি অনুবাদ নেই।
হুনিং এই বই দিয়ে চীনাদের জন্য আমেরিকাকে চেনার উপায় করে দিয়েছেন। তিনি দেখেছেন কেমন করে আমেরিকা তার সমৃদ্ধির গোড়া কালো মানুষদের অচ্ছুত করে রেখেছে আজও। দেখেছেন আমেরিকার সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পরিবারের কাঠামোকে ফাঁপা শূন্য করে তুলেছে।
আমেরিকার রাজনীতিতে নির্বাচন হয়ে গেছে সবচেয়ে বড় সেলিং ইভেন্ট। আলোঝলমল মঞ্চে নির্বাচনের প্রার্থীরা বিতর্কে নামেন। সযত্ন বাগ্মিতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় সমস্যার মূল। হুনিংয়ের কথায়, ‘রাজনৈতিক দলগুলো আমেরিকায় ফেরি করে বেড়ায়। তাদের পণ্য হচ্ছে নির্বাচনের প্রার্থীরা। আর ভোটার এই বাজারের পণ্যগুলোর মধ্য থেকে একটা খরিদ করে।’
আমেরিকায় যন্ত্রের ব্যবহার দেখে হুনিং মুগ্ধ হয়েছেন। দেখেছেন কেমন করে অন্ধ বা পঙ্গুদেরকেও যন্ত্র সচল করে তোলে। তবে মানুষ হিসেবে তাঁদের সমস্যার সমাধান হয়নি। এ–ও লক্ষ করেছেন যে এখানে মানুষ আর যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে না। যন্ত্রই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেখান থেকে তিনি চীনের জন্য একটা পরামর্শও দিয়েছেন, ‘আমেরিকানদের ছাপিয়ে যেতে হলে একটা কাজ করতেই হবে। তাঁদের ছাপিয়ে যেতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে।’
এই বই ছাপা হওয়ার পর হুনিংয়ের জীবনের যাত্রাপথ বদলে যাওয়া শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে। তিনি ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বিপুলসংখ্যক চীনা নাগরিক পশ্চিমে অভিবাসন করতে আগ্রহী ছিল। তাঁদের নিরুৎসাহিত করতে রাষ্ট্র হুনিংয়ের বইটিকে সফলভাবে ব্যবহার করেছে।
চীন যখন সি চিন পিংয়ের ‘মহান পুনরুজ্জীবন’ নীতি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সেই সঙ্গে এটি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পশ্চিমা রাজনৈতিক ধারণাগুলো থেকে চীন একেবারে সরে গেছে।
আমেরিকায় পরিবার বলতে এখন আর কিছু নেই। তরুণেরা নিজেদের পশ্চিমা ঐতিহ্য একেবারেই বিস্মৃত হয়েছে। তাহলে সমাজের বুনন কী করে ধরে রাখা যাবে? হুনিং প্রশ্ন করছেন, ‘কোনো সমাজে যদি মূল্যবোধ না থাকে, তাহলে সে সমাজ টিকবে কী করে?’
এই প্রশ্ন চীনে মাও সে–তুংয়ের আমল থেকে চর্চা হয়েছে। ষাটের দশকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের নাম মুছে দেওয়া হলো, তখন মাও সে তুং তা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে সেই ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়।
হুনিং আমেরিকা দেখে এসে মাও-এর এই ধারণাকে নতুন করে প্রস্তাব করলেন। বললেন যে জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখতে হবে জনগণের ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। তাঁর ভাষায় এ হলো ‘সাংস্কৃতিক জিন’। শরীরের মতো মানুষের মনোজগতেরও গঠন আছে। একে বুঝতে না পারলে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। হুনিংয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধ হয় এই যে তিনি চীনা জনগণের ‘সাংস্কৃতিক জিন’ বুঝতে পারেন। আর বোঝেন চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার সমাজকে।
সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে পশ্চিমের ধারণা মোটামুটি পুরো পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত। এর বাইরে আর কোনো বয়ান হাজির নেই প্রায়। হুনিং চীন নিয়ে পশ্চিমা বয়ানের বাইরে বের হয়ে এসেছেন পশ্চিমা পৃথিবীকে পর্যালোচনা করে।
চীন যখন সি চিন পিংয়ের ‘মহান পুনরুজ্জীবন’ নীতি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সেই সঙ্গে এটি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পশ্চিমা রাজনৈতিক ধারণাগুলো থেকে চীন একেবারে সরে গেছে। এই সরে আসার নকশা তৈরি হয়ে ওয়াং হুনিংয়ের হাতে। গত আগস্টে কমিউনিস্ট পার্টি নতুন স্লোগান প্রকাশ করেছে। স্লোগানটি হলো ‘সবার সমৃদ্ধি’। এর উদ্দেশ্য হলো চীনে বাড়তে থাকা সম্পদের ব্যবধান সমস্যার প্রতিকার। সম্প্রতি চীন অতি ধনীদের ওপর যে খড়্গহস্ত হয়েছে, তা এই কার্যক্রমের অংশ।
তবে এই কার্যক্রমের অর্থনৈতিক দিকের সঙ্গে একটা গভীর সাংস্কৃতিক যুক্তি রয়েছে। এই যুক্তিও এসেছে হুনিংয়ের ভাবনা থেকে। নতুন প্রচারণার রূপরেখা দিতে গিয়ে বক্তৃতায় সি চিন পিং বলেছেন চীন যেন ‘সামাজিক কাঠামো ছিঁড়ে’ ফেলা থেকে সতর্ক থাকে। পশ্চিমের কিছু দেশ ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য রুখতে না পেরে এখন বেকায়দায় পড়েছে। এই কথাগুলো অবিকল হুনিংয়ের বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, জনগণের মূল্যবোধের মধ্যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ভাবনা তৈরি করতে হবে। এটা অনেকটা ‘শার্টের বোতাম লাগানোর মতো। প্রথমটা ভুল জায়গায় লাগালে, বাকিগুলোও ভুল জায়গায় লাগবে।’
জাভেদ হুসেন সম্পাদকীয় সহকারী, প্রথম আলো