ছেলেকে খুন, বাবার আত্মহত্যা: কেউ দায়ী নয়!

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মশিউর রহমান একা আত্মহত্যা করেননি। আত্মহত্যার আগে তিনি ছেলে সাহদাবকে হত্যা করেছেন। মেয়েকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছেন। মেয়েটি বেঁচে আছে। গুরুতর অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

রোববার সন্ধ্যায় তালতলার মোল্লাপাড়া এলাকার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় মশিউরের স্ত্রী বাইরে টিউশনিতে ছিলেন। তিনি বাসায় ফিরে এসে দরজা বন্ধ দেখতে পান। অনেক ডাকাডাকির পরও কোনো সাড়া না পেয়ে বিষয়টি জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ জানান তিনি।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের সহকারী কমিশনার মো. ইমরান হোসেন বলেন, ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আর্থিক অনটনে ছিলেন মশিউর রহমান। ধারণা করা হচ্ছে, হতাশা থেকে কোনো কিছু দিয়ে ছেলে-মেয়েকে কুপিয়ে ও ফাঁস দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানোর পর নিজে আত্মহত্যার পথ নিয়েছেন মশিউর।

আত্মহত্যার আগে তিনি সুইসাইড নোটে লিখেছেন, ‘কেউ দায়ী নয়’। এই নোটের মাধ্যমে তিনি জানাতে চেয়েছেন, তার মৃত্যু নিয়ে যেন আইনি ঝামেলা না হয়। যিনি নিজ হাতে এই নোট লিখতে পারেন তিনি কী করে সন্তানকে হত্যা করতে পারলেন? যেই সন্তানদ্বয়কে ছোটবেলা থেকে লালনপালন করেছেন, তাদের বুকেই ছুরি চালালেন বাবা!

পারস্যের রুস্তম–সোহরাব কাহিনিতে পিতার হাতে পুত্র খন হন যুদ্ধ ক্ষেত্রে। রুস্তম পুত্রের পরিচয় না জেনেই সোহরাবকে খুন করেছিলেন। কিন্তু আগারগাঁওয়ের মশিউর পুত্র–কন্যার পরিচয় জেনেই তাঁদের বুকে ছুরি চালিয়েছেন। পুত্র মারা গেলেও কন্যাটি বেঁচে আছেন। কেন এমন কাণ্ড করলেন মশিউর।

বাংলাদেশে আর্থিক অনটনে কে নেই? যারা চাকরি করে, রাজনীতি বা ব্যবসা করে আলাউদ্দিনের চেরাগ চালিয়েছেন,  তাদের বাইরে সবাই আর্থকি অনটনে আছেন।  হিসেব নিকেশ করে সংসার চালাতে হয়।

আর্থিক অনটন থাকলে পারিবারিক অশান্তি থাকাও অস্বাভাবিক নয়। যখন ছেলে–মেয়ের পড়াশোনার খরচ মেটানো যায় না, যখন খাবার কেনারও পয়সা থাকে না, তখন পারিবারিক অশান্তি দেখা দিতেই পারে।

তাই বলে আত্মহত্যা করতে হবে? আত্মহত্যাকে মহা পাপ বলা হয়। আর ছেলেকে হত্যা এবং মেয়েকে হত্যা চেষ্টার পর আত্মহত্যাকে কী বলে অভিহিত করা যায়। এটা তো জঘন্য অপরাধ।

মধ্য বয়সে এসে কেন মশিউরের মরিবার হলো সাধ? জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগে কবিতার নায়ক একাই মরেছেন। কিন্তু মশিউর একা মরেননি। নিজে মরার আগে কলেজ পড়ুয়া ছেলেকেও মেরেছেন। আহত মেয়েটি সুস্থ হলে মায়ের হয়তো বেঁচে থাকার একটি অবলম্বন থাকবে।

মশিউর নিজের মৃত্যুর জন্য ‘কেউ দায়ী নয়’ লিখেছেন। সেটা তিনি লিখতে পারেন। আত্মহত্যা পাপ জেনেও তিনি সেই পথ বেছে নিতে পারেন। কিন্তু সন্তা্নকে হত্যা করতে পারেন না।

স্বামী বেকার থাকায় যেই স্ত্রী টিউশনি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন, তাঁকেও আত্মহত্যার জন্য দায়ী করা যাবে না। তিনি তো সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন।

মশিউরের স্ত্রী মজিদা খাতুন জানান, মশিউরের শেয়ারবাজারের  ব্যবসা অত্যন্ত খারাপ ছিল। এ ছাড়া তিনি পাঁচ-ছয় বছর আগে দক্ষিণখান এলাকার রতন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে সাড়ে ৩ কাটা জমি কেনেন। পরে জানা যায়, জমির দলিল ভুয়া। জালিয়াতি করে রতন ওই জমি মশিউরের কাছে বিক্রি করেছে। এরপর জমির টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিলেও দিচ্ছি দেব বলে ঘুরাচ্ছিলেন।

শেয়ারবাজার এমন একটি ব্যবসা সেখানে লাভ–লোকসান দুটোই আছে।  কিন্তু সেই লোকসানের পেছনে যদি স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি থাকে এবং শেয়ারবাজার থেকে সেই রাঘব বোয়ালেররা হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে থাকে, তাহলে কি মশিউর রহমানের ‘কেউ দায়ী নয়’ কথাটি খাটবে?

কীভাবে তাদের সংসার  চলত?  মজিদা খাতুন চারটি টিউশনি করতেন।  তিনটি শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে পড়াতেন।  আর একটা বাসায় এসে পড়ে যায়। এ থেকে মাসে আয় হয় ৮ হাজার টাকা। রোববার টিউশনি শেষ করে পৌনে ৪টার দিকে বাসায় এসে দেখেন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। দরজা ভেঙে দেখি ঘরের এক রুমে মেয়েটা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। আরেক রুমে খাটের ওপরে ছেলে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। ওই রুমের সিলিং ফেনের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন।

একজন প্রকৌশলী হয়েও মশিউর রহমান তিন বছর ধরে বেকার ছিলেন। তিনি কোনো কাজ জোগার করতে পারেননি। সেটা তাঁর ব্যর্থতা হতে পারে। সরকার স্বীকার না করলেও বাংলাদেশে এখন সকার লোকের চেয়ে বেকার লোকের সংখ্যা বেশি। আইএলও সকারের যেই সংজ্ঞা দিয়েছে, সেটা উদ্ভট বলেই মনে হয়। সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজ করে কেউ চলতে পারেন না।

মশিউর রহমান তিন বছর চাকরি না পেলেও কিছু করার চেষ্টা করেছেন। কী করেছেন? তাঁর সঞ্চিত সমুদয় অর্থ শেয়ারবাজারে খাটিছেন এবং  সর্বসান্ত্ব হয়েছেন। কেবল মশিউর একা নন। আরও অনেকে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়ে এভাবে সর্বসান্ত্ব হয়েছেন।

একজন প্রকৌশলী তিন বছর ধরে বেকার ছিলেন। তিনি কোনো কাজ জোগার করতে পারেননি। সেটা তাঁর ব্যর্থতা হতে পারে। সরকার স্বীকার না করলেও বাংলাদেশে এখন সকার লোকের চেয়ে বেকার লোকের সংখ্যা বেশি। আইএলও সকারের যেই সংজ্ঞা দিয়েছে, সেটা উদ্ভট বলেই মনে হয়। সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজ করে কেউ চলতে পারেন না।

মশিউর রহমান তাঁর সঞ্চিত সমুদয় অর্থ শেয়ারবাজারে খাটিছেন এবং  সর্বসান্ত্ব হয়েছেন। কেবল মশিউর একা নন। আরও অনেকে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়ে এভাবে সর্বসান্ত্ব হয়েছেন।  

শেয়ারবাজার এমন একটি ব্যবসা সেখানে লাভ–লোকসান দুটোই আছে।  কিন্তু সেই লোকসানের পেছনে যদি স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজি থাকে এবং শেয়ারবাজার থেকে সেই রাঘব বোয়ালেররা হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে থাকে, তাহলে কি মশিউর রহমানের ‘কেউ দায়ী নয়’ কথাটি খাটবে?

যারা প্রতিদিন উন্নয়নের গল্প শোনান তাঁরা কি এ্ই বেকার হওয়া এবং শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়ে সর্বস্ব হারানো মানুষগুলোর খোঁজ রাখেন?

২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটি কিছু সুপারিশও করেছিল। কিন্তু তারপরও শেয়ারবাজার একই ধারায় চলছে।  

মশিউরের আত্মহত্যা ও পুত্র হত্যার খবরটি যখন পড়ছিলাম, তখন আরও দুটি মৃত্যুর খবর চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

১ এপ্রিল গাইবান্ধা শহরের আদর্শ কলেজ সংলগ্ন এলাকায় এক নারী দেড় বছরের শিশুসহ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে অভিমান করেই নাকি এই কাজ করছিলেন। ওই পথ দিয়ে তখন প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছিলেন জোবায়ের মিয়া। এই দৃশ্য দখতে পেয়ে তিনি মা ও সন্তানকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ট্রেনের নিচে কাটা পড়েন মা ও জোবায়ের মিয়া। রেললাইনের বাইরে ছিটকে পড়ায় বেঁচে যায় শিশুটি।

জোবায়ের মিয়া ছিলেন গরিব বাবা–মার একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়েই তাদের যে স্বপ্ন ছিল, ট্রেনের নিচে তা চিরতরে হারিয়ে গেল। এ রকম কত তরুণের স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে, রাষ্ট্র কি তার খোঁজ রাখে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি