কিছুদিন আগে আমার দুই বন্ধু পাসপোর্ট করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন চালু হয়েছে চিপ লাগানো ই-পাসপোর্ট, মেয়াদ ১০ বছর। অনলাইনে দরখাস্ত করতে গিয়ে বিপত্তি। একজনের বয়স ৬৪ বছর ১০ মাস, তাঁর কোনো সমস্যা হলো না। অন্যজনের ৬৫ পেরিয়ে গেছে কদিন আগে, তাঁর দরখাস্তে মেয়াদ আসে ৫ বছর। যতবারই চেষ্টা করেন, ১০ বছর আর হয় না। অগত্যা খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তিনি ‘বুড়ো’ হয়ে গেছেন, তাঁকে আর ১০ বছরমেয়াদি পাসপোর্ট দেওয়া হবে না। ক্ষুব্ধ হলেন তিনি স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু নিয়ম বলে কথা। অগত্যা তিনি ৫ বছরমেয়াদি পাসপোর্টকেই তথাস্তু বলে মেনে নিলেন।
অনেক চিন্তাভাবনা করেও এই ‘নিয়ম’-এর কোনো যৌক্তিকতা আমি আবিষ্কার করতে পারলাম না। ই-পাসপোর্টের সমন্বয়কারী আন্তর্জাতিক অসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও)। এমন হতে পারত যে আইকাও এ রকম কোনো রূপরেখা দিয়েছে, যার কারণে এটা করতে হয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে অনেক খুঁজেও এমন কিছু পেলাম না। কৌতূহল মেটাতে কানাডার পাসপোর্ট-সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। স্পষ্ট নির্দেশনা, ১৬ বছরের নিচের শিশুদের পাসপোর্টের মেয়াদ ৫ বছর, এর ওপরের সবার জন্য আবেদনকারীর ইচ্ছা অনুযায়ী ৫ বা ১০ বছর। বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য আলাদা কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। কোনো কোনো দেশে সবার জন্যই মেয়াদ ৫ বছর, যেমনটি একসময় বাংলাদেশেও ছিল। ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে তাহলে বাংলাদেশের প্রবীণদের জন্য এই ব্যত্যয় কেন?
এর একটাই কারণ হতে পারে, এই বৃদ্ধ আবেদনকারী তো ৫ বছরের বেশি বাঁচবেন না, কাজেই এর চেয়ে বেশি মেয়াদের পাসপোর্ট দিয়ে তিনি করবেনটা কী! মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে যেকোনো সময়, কিন্তু ৭০ বছর বয়সে একজন মানুষ যে মারা যাবেনই, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের গড় আয়ুই এখন ৭৩, কাজেই ৭০–এর পর আরও ৩ বছর তাঁর বাঁচার সম্ভাবনাই অধিক। আর মানুষ যে ৭৫ বা ৮০ বছর বাঁচে না, তা-ও তো নয়। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? ৭০ বছরেও যদি তিনি বেঁচে থাকেন এবং কার্যোপলক্ষে বা চিকিৎসার জন্য তাঁর বিদেশ যাত্রার প্রয়োজন হয়, তাহলে আবার পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করতে হবে তাঁকে। আর তাঁর দুই মাসের কম বয়সী বন্ধু দিব্যি এই ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকবেন।
ধরা যাক, পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মারা গেলেন একজন মানুষ। বস্তুত অহরহ প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছেন এ রকম, তাঁদের বয়স ৪০ হতে পারে বা ৮০, পাসপোর্টের মেয়াদ তো আর কারও আয়ু বৃদ্ধি করে না। মৃত্যুর পর সেই ব্যক্তির ই-পাসপোর্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল বা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যাবে। আগে যখন হাতে লেখা পাসপোর্ট ছিল, তখন ছবি বদলে ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে মানব পাচারের সুবিধা ছিল। এমআরপি চালুর পর সে সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। কাজেই ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তিকে যদি অন্যদের মতোই দীর্ঘমেয়াদি পাসপোর্ট দেওয়া হয় এবং খোদা না খাস্তা যদি তিনি পাসপোর্টের মেয়াদ থাকাকালেই মারা যান, সেই পাসপোর্ট নিয়ে কোনো ঋণখেলাপি বা খুনের আসামি দেশত্যাগ করতে পারবে, এমন সম্ভাবনা এখন আর নেই। বস্তুত এ ধরনের ব্যক্তিরা যখন দেশত্যাগ করেন, তখন তা আটঘাট বেঁধেই করেন এবং তাঁদের আটকানোর নির্দেশ ঘটনাক্রমে বৈধ পাসপোর্ট তাঁদের দেশত্যাগের দুই ঘণ্টা পর বিমানবন্দরে পৌঁছায়!
তাহলে কেন এই উদ্ভট নিয়ম? সরকারি চাকরিতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে মনে করি, সম্ভবত কোনো একজনের উর্বর মস্তিষ্কে ধারণাটা এসেছে যে অত বয়স্ক ব্যক্তিদের ১০ বছরমেয়াদি পাসপোর্টের প্রয়োজন নেই, আর তাঁর আশপাশের আরও কিছুজন তাতে একমত হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে এই নিয়ম। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট না দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত সোজাসাপটা বৈষম্যমূলক, কোনো ন্যায়সংগত কারণ নেই এর। এই অন্যায় এবং অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত অবিলম্বে পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাস প্রবীণদের জন্য কোনো আদর্শ সমাধান নয়। তবে সমসাময়িক জীবনবাস্তবতায় এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই বিরাটসংখ্যক প্রবীণের জন্য। প্রবীণদের প্রয়োজনগুলো অনেক সময়ই অবহেলার শিকার হয়, এ রকম ঘটনা অহরহ দেখা যায়। বিত্তশালীরা অর্থ ব্যয় করে তাঁদের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি সৃষ্টি করে নিতে পারেন। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রবীণদের সে সাধ্য থাকে না প্রায়ই।
পয়লা অক্টোবর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবছর দিনটি উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশেও যথারীতি দিনটি উদ্যাপিত হয়। এদিন পত্রপত্রিকায় প্রবীণদের সমস্যাদি এবং তার প্রতিকার নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি হয়। কিছু লেখা থাকে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে এবং প্রায়ই দেখা যায়, অতি সংবেদনশীল মনোভাব থেকে এসব লেখার সুর হয় নেতিবাচক। আমার মনে হয় এ নিয়ে বিকল্প চিন্তার অবকাশ আছে।
কৃষিভিত্তিক সমাজে সাধারণভাবে প্রবীণেরা অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। যৌথ পরিবারে ভূমির আমৃত্যু মালিকানা ছিল প্রবীণদের হাতে, কাজেই তাঁদের সম্মান ও প্রভাব বহাল থাকত বৃদ্ধকালেও। ছেলেপুলে, নাতিপুতি নিয়ে একরকম সমৃদ্ধ জীবন ছিল তাঁদের, এমনকি দারিদ্র্য থাকলেও। বৃদ্ধ মাতা-পিতার দেখাশোনা ছেলেমেয়েদের, বিশেষত ছেলেদের দায়িত্ব হিসেবেই গণ্য হতো। পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে। কৃষক পরিবারের সন্তানেরাও বেরিয়ে পড়ছে ভিন্ন জীবিকায়, শহরে অভিবাসন হচ্ছে বিপুল সংখ্যায়। যৌথ পরিবারপ্রথাও ভেঙে পড়েছে। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনই জীবিকার অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন, এটা খুবই সাধারণ দৃশ্য। নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত অধিকাংশ পরিবারে প্রায়ই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। একজন বা দুজন প্রবীণের দেখভালের জন্য সে সংসারে প্রয়োজনীয় সুবিধা সৃষ্টি অনেকেরই সাধ্যাতীত। এমন পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রবীণদের জন্য প্রবীণ নিবাস একটি গ্রহণযোগ্য ভালো বিকল্প হতে পারে।
বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাস প্রবীণদের জন্য কোনো আদর্শ সমাধান নয়। তবে সমসাময়িক জীবনবাস্তবতায় এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই বিরাটসংখ্যক প্রবীণের জন্য। প্রবীণদের প্রয়োজনগুলো অনেক সময়ই অবহেলার শিকার হয়, এ রকম ঘটনা অহরহ দেখা যায়। বিত্তশালীরা অর্থ ব্যয় করে তাঁদের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি সৃষ্টি করে নিতে পারেন। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রবীণদের সে সাধ্য থাকে না প্রায়ই। সমাজের জন্য কিছু করতে ইচ্ছুক বা পরকালের জন্য সঞ্চয়ে আগ্রহী অনেক বিত্তশালী মানুষ নিজ উদ্যোগে এমন প্রবীণ নিবাস গড়ে তুলছেন, যেখানে বিত্তহীন প্রবীণদের জন্য থাকা-খাওয়া এবং মৌলিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে। বাস্তবতা বিবেচনায় বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পরিহার করলে এমন উদ্যোক্তারা যেমন উৎসাহী হবেন, পাশাপাশি অনেক অসহায় প্রবীণ জীবনের শেষপাদে মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে সক্ষম হবেন।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব