মতামত

ঘাঘটের বালু উত্তোলন বন্ধ করতে বাধা কোথায়

ঘাঘট নদে বালু উত্তোলন
ঘাঘট নদে বালু উত্তোলন

মাসখানেক আগে রংপুরের জেলা প্রশাসককে মুঠোফোনে ঘাঘট নদ থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি অবগত করি। বালু উত্তোলনের কয়েকটি ছবি এবং ঠিকানাও হোয়াটসঅ্যাপে দিই। এতে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। একইভাবে রংপুর সদরের ইউএনও, আরডিসি রংপুর, রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছেও অনুরোধ করি বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। বালু উত্তোলন বন্ধ হয় না।

বালু উত্তোলন, নদীর দখল-দূষণসহ নদীর যেকোনো রকম ক্ষতির বিষয়ে রংপুর বিভাগে যত জেলায় আমরা প্রতিকার চেয়েছি, সেটি পেয়েছি। একটি বিষয়ে সাধারণত একাধিকজনের কাছে আমাদের প্রতিকার চাইতে হয়নি। ঘাঘটের প্রশ্নে রংপুরে একাধিক কর্মকর্তার কাছে প্রতিকার চেয়েও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই প্রশাসনের কাছে আমরা শালমারা নদী রক্ষায় সহায়তা পেয়েছি। তাহলে ঘাঘটের বালু উত্তোলন বন্ধ অসম্ভব হলো কেন বুঝতে পারছি না।

বালু উত্তালনের স্থানটি একদিন সরেজমিনে দেখতে গেলাম। আমি যাওয়ায় স্থানীয় অনেকেই এলেন। স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে শুনলাম আট মাস ধরে একই স্থান থেকে বালু উত্তোলন চলছে। ঘাঘট নদে বালু উত্তোলন হচ্ছে দিনদুপুরেই। সারা দিন বালু তোলা হয়, সারা রাত বালু সরানো হয়।

ঘাঘট নদের অবস্থা দেখে প্রশ্ন জাগছে, জেলা প্রশাসনের গুরুত্ব কি জনগণের কাছে কমে গেছে? একটি স্থানে বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা গিয়ে নিষেধ করে আসার পরও নতুন করে একই কাজ করার সাহস পান কীভাবে?

বালু তুলে রাখার দুটি স্থান। একটিতে বালু তুলে রাখা হয় যেদিন, তার পরের দিন সেখান থেকে ট্রাক্টরে করে বালু নিয়ে যাওয়া হয়। কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। দেশের অবস্থা কি স্থান বিশেষে এতটাই ভয়াবহ হয়েছে যে এত বড় সর্বনাশের প্রতিবাদটুকু করা যাবে না? ঘাঘট নদের অনেক স্থানে বালু উত্তোলন চলছে।

নদের কাছেই বহুতল ভবনের ভিত্তি দিয়ে বাড়ি করা হয়েছে। সেই বাড়ি-সড়কসহ সেখানকার অবকাঠামো এবং জনজীবন চরমতম হুমকির মধ্যে। আমার সঙ্গে যাঁরা যোগাযোগ করেন, তাঁরাও তটস্থ থাকেন কেউ জেনে যায় কি না তাঁদের কথা। শুনলাম সেখানকার একজন ব্যক্তি বিদেশে থাকেন। তিনি দেশে এসে বালু উত্তোলনের ছবি তুলেছিলেন। বালু উত্তোলনকারীরা তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নিয়েছিলেন। ছবি মুছে দেওয়ার শর্তে মুঠোফোন ফেরত দিয়েছেন।

স্থানীয় ব্যক্তিদের অসহায়ত্ব দেখে মনে পড়ল ছিটমহলবাসীর জীবনের কথা। যারা দেশে থেকেও দেশের কোনো সুবিধা পেত না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এই ঘাঘট নদের তীরেই অগণিত মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ দিয়েছেন দেশটার জন্য। তাঁরা কি অসহায়দের আর্তনাদ শুনতে পান? শুনেছি, যাঁরা বালু উত্তোলন করেন, তাঁরা নাকি ক্ষমতার বড়াই করেন। বালু উত্তোলনের এ ঘটনা রংপুর সিটি করপোরেশনের ভেতরেই। এসব দেখার জন্য সরকারের বেতনভোগী কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি কি নেই? এ রকম ঘটনায় জনমনে এ ধারণা হওয়া অমূলক নয়, বালু উত্তোলনকারীদের বালু বিক্রির টাকা ভাগাভাগি হয়।

উপায়ন্তর না পেয়ে ঘাঘট নদের বালু উত্তোলনের বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার বরাবর হোয়াটসঅ্যাপে আবেদন করি। সেখানে উল্লেখ করেছি, অনেকের কাছে প্রতিকার চেয়েও পাইনি। আবেদনের অনুলিপি জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি। এই আবেদনের পরদিনই জেলা প্রশাসনের পক্ষে ঘাঘটের নির্দিষ্ট স্থানে অভিযান চালানো হয়।

এই অভিযান যে ‘আইওয়াশ’, এটি বুঝতে বাকি ছিল না। প্রায় আট মাস ধরে যে মেশিনে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, সেই মেশিন বালু উত্তোলনকারীরা যেখানে রেখেছিলেন, সেখানে রেখেই অভিযান সম্পন্ন করা হয়। একটি শিশুও বুঝবে মেশিনটি না সরালে ওই মেশিনে বালু উত্তোলন আবারও শুরু হবে। নদীপাড়ের মানুষের কাছে শুনলাম, আবারও বালু উত্তোলন শুরু হয়ে গেছে।

আমরা সামাজিক আন্দোলন করতে পারি। বন্ধ করার দায়িত্ব-ক্ষমতা কোনোটি আমাদের নেই। আমি রংপুর জেলা নদী রক্ষা কমিটির একজন সদস্য, রংপুর বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটির সদস্য। নদী রক্ষাবিষয়ক একটি সংগঠনের একজন সক্রিয় কর্মী। আমার মতো মানুষকে একটি নদী থেকে সামান্য বালু উত্তোলন বন্ধ করতে যদি এতটা বেগ পেতে হয়, তাহলে দখলদারদের হাত থেকে নদী-বিল রক্ষা করবে কে?

আমরা যাঁরা নদী সুরক্ষায় আন্দোলন করি, তাঁদের সবার ভিন্ন কর্মজীবন আছে। অতিরিক্ত কাজ হিসেবে নদীর কাজ করি। নদী সুরক্ষায় একটি কাজে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিকে বারবার বলাটা বিরক্তির। কিন্তু তাঁদের না বলে প্রতিকার চাওয়ার স্থানীয় আর কোনো জায়গাও তো নেই। হয়তো অনেক সময় তাঁরা বিরক্ত হন। তবু আমাদের বারবার বলতেই হয়।

ঘাঘট নদের অবস্থা দেখে প্রশ্ন জাগছে, জেলা প্রশাসনের গুরুত্ব কি জনগণের কাছে কমে গেছে? একটি স্থানে বালু উত্তোলন বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা গিয়ে নিষেধ করে আসার পরও নতুন করে একই কাজ করার সাহস পান কীভাবে? প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পরও বালু উত্তোলন শুরু হওয়ায় ওই স্থানের সাধারণ অসহায় মানুষেরা জেলা প্রশাসন সম্পর্কে কী ধারণা করতে পারেন, তা-ও আমাদের সবার ভাবার প্রয়োজন আছে।

সম্প্রতি বগুড়া জেলা প্রশাসনের সাহসী এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখেছি। করতোয়া নদী ভরাটের কাজ অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে তারা। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে চাকিরপশার নদের যে স্থান বিলশ্রেণিভুক্ত, সেখানে একজন পুকুর বানাচ্ছিলেন। জেলা প্রশাসককে জানালে তিনি নিজেই পুলিশ সুপারসহ ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। লালমনিরহাটে তিস্তায় গভীর রাতে বালু উত্তোলন হতো। আমাদের অনুরোধে রাত তিনটায় অভিযান চালানো হয়।

তখন সেই কাজ বন্ধ হয়েছিল। রংপুর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় শালমারা নদী ও নীলফামারী জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ডোমারে দেওনাই নদ অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। আমরা মনে করি, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের এসব অবৈধ কাজ বন্ধ করা কঠিন কোনো বিষয়ই নয়। কিন্তু এর জন্য সদিচ্ছা জরুরি। নদী সুরক্ষার বিষয়ে আমরা অতীতের মতোই রংপুর জেলা প্রশাসনকে দেখতে চাই।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক