অকালমৃত্যু বা খুনের সঙ্গে এসব তামাশারও কি বিরতি নেই

১৯৭৪ সালে রাজনীতিবিদ ও লেখক নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। অথচ ৫০ বছর পরেও আমাদের নিয়মিতভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য শোক করতে হচ্ছে, প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। কিন্তু বিকার নেই শাসনযন্ত্রের, প্রতিকার নেই এই অবিরাম খুনপ্রবাহের। আসলে জীবনই যেখানে স্বাভাবিক নয়, সেখানে মৃত্যু কীভাবে স্বাভাবিক হবে? 

ত্বকী কখনোই একা নয়। সরকারি দলের ক্ষমতাবানদের হাতে এই কিশোর কবি-লেখক-শিল্পী খুন হয় ১১ বছর আগে। সব প্রমাণ-দলিল প্রস্তুত করেও সেই বিচার ওপরের আদেশে থেমে গেছে। ওপরের আদেশ না থাকায় তনু খুন-ধর্ষণের বিচার হচ্ছে না, সাগর-রুনির বিচার পিছিয়ে যাচ্ছে ১২ বছর ধরে। বিচার নেই, প্রতিকার নেই, তাই খুনসহ অস্বাভাবিক-অকালমৃত্যুরও কোনো শেষ নেই। তালিকা বাড়ছে। বিচার, আইন—সবই ক্ষমতার ইচ্ছার অধীন। 

এখন দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে না, সব হয় ওপরের আদেশে কিংবা ইঙ্গিতে কিংবা ওপরের নামে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে, বিচারব্যবস্থা স্বাধীনভাবে কার্যকর না থাকলে, শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে একটি দেশ কী অবস্থায় যায়, বাংলাদেশ তারই একটি দৃষ্টান্ত। ঘরে-বাইরে, সড়কে, যানবাহনে, প্রতিষ্ঠানে, বাজারে, জাতীয় অর্থনীতিতে, রাষ্ট্রনৈতিক তৎপরতায় সর্বত্র আমরা তারই মাশুল দিচ্ছি। 

বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি কর্তৃত্ব এখন নিরঙ্কুশ। মুক্তচিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ, সৃজনশীলতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা—সবকিছুর প্রধান কেন্দ্র হওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

স্বায়ত্তশাসিত বলে পরিচিত যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়, সেগুলোকেও পরিকল্পিতভাবে অথর্ব করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রধান যোগ্যতা এখন সরকারের পূর্ণ আনুগত্য এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সহযোগী ভূমিকা। হলগুলোকে নির্যাতনের কারখানা বানানো হয়েছে। জাতীয় স্বার্থ নিয়ে মতপ্রকাশের ‘অপরাধে’ হলে ছাত্রকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। আবরার একজনের নাম।

এই লেখার সময়ই আমার সামনে সংবাদপত্রের খবর—বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ একেবারেই তরুণ। এর আগে নিমতলা, হাশেম ফুড, চুড়িহাট্টা ও বনানীর চিত্র একই রকম।

কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থার ঠিক নেই, আগুন ধরার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত, কিন্তু নেভানোর ব্যবস্থা ভাঙাচোরা, ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থায় জাঁকজমক আছে, কিন্তু বিপদ হলে বের হওয়ার রাস্তা পাওয়া যায় না। খোলা জায়গা নেই, পানির ব্যবস্থা নেই। এগুলো ছাড়াই তালি পেতে পেতে ঝকঝকে উন্নয়নের বহুতল ভবন উঠছে ঢাকায়। এগুলো অনুমোদনও পায় তাড়াতাড়ি, কাগজে-কলমে তদারকি, কেনা যায় সবই।

অভাব বাড়ছে, কারণ সরকারঘনিষ্ঠ কিছু লোকের সম্পদ অভূতপূর্ব মাত্রায় বাড়ছে, তার সামান্য নমুনা বিতর্কিত নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় পাওয়া যায়! বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর গত কয় বছরে তাঁদের সম্পদ বেড়েছে শত শত গুণ। এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই তাদের প্রয়োজন গণতন্ত্রবিহীন ব্যবস্থা! প্রয়োজন সর্বজনের মতপ্রকাশের ওপর খড়্গ বসানো! 

একের পর এক তাই এসব জানা ‘দুর্ঘটনায়’ মানুষ মরতে থাকে। আর লাশ গুনতে গুনতে আমরা শুনি সরকারের তদন্ত কমিটি আর দুঃখ প্রকাশের খবর। অকালমৃত্যুর বা খুনের সঙ্গে সঙ্গে এসব তামাশারও কোনো বিরতি নেই! 

নিয়মিত চলছে সড়কে মৃত্যু। সমাধান হাতের কাছে থাকলেও কোনো উদ্যোগ নেই। ডেঙ্গুতে মৃত্যু। বিগত ছয় বছরেও এতসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি, যত হয়েছে এই বছরে। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের প্রতি নির্লিপ্ততা, লোভ, দুর্নীতি ও সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে সমাধানের পথ উপেক্ষিতই থেকেছে। আর মানুষ ভুগছে, মরছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নজরদারি আর নিপীড়নের আবহাওয়া অব্যাহত আছে দশকের পর দশক। পাহাড়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন আছে, অথচ সহিংসতা চলছেই।

খুন হচ্ছে একের পর এক। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেছেন, পাহাড়ে খুনের ধরন দেখে মনে হয়, তরুণ সম্ভাবনাময় ও জনপন্থী নেতৃত্ব যাতে গড়ে না ওঠে, সে জন্যই এসব হত্যাকাণ্ড চলছে।

নির্বাচনের আগে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করছিলেন। প্রতিবারই মজুরির কথা বলতে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ করে না।

এবারও মজুরি নিয়ে কোনো যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে মালিকদের প্রস্তাবই মেনে নেওয়া হয়েছে। আর আন্দোলনকারী শ্রমিকের ওপর পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের সম্মিলিত আক্রমণ হয়েছে। একজন নারীসহ চারজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, জখম হয়েছে আরও অনেকে। এগুলোরও কোনো বিচার নেই।

দ্রব্যমূল্যে মানুষ যখন দিশাহারা, তখন আবারও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, ভর্তুকি এত বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। আইএমএফও তা-ই বলছে। অথচ এর কারণ দূর করার কোনো আগ্রহ নেই তাদের কারও।

কতিপয় কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখার জন্য তাদের ১০ বছরে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে ঋণনির্ভর, আমদানিনির্ভর, বিদেশি কোম্পানি ও দেশি বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীনির্ভর, এলএনজি-কয়লা-পারমাণবিকনির্ভর ব্যবস্থা করার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। আর সেই ব্যয় মেটাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম।

এই পথে চললে দাম এ রকম বাড়তেই থাকবে। অথচ এর বিকল্প অনেক নিরাপদ, সুলভ পথ ছিল। সে পথে গেলে কিছু গোষ্ঠীর খুব কম সময়ে বিত্তের পাহাড় তৈরি সম্ভব ছিল না। সে জন্য বাংলাদেশের নতুন ২২ পরিবার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ফুলেফেঁপে উঠছে। আর তারাই এখন দেশ চালায়।

এদিকে জিনিসপত্রের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরে একটু ঘুরলেই বোঝা যায় পাড়া–মহল্লা, সড়ক, বাজার, হোটেল, স্টেশনসহ সম্ভাব্য সব জায়গাতেই ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের একটি বড় অংশ নতুন।

অভাব বাড়ছে, কারণ সরকারঘনিষ্ঠ কিছু লোকের সম্পদ অভূতপূর্ব মাত্রায় বাড়ছে, তার সামান্য নমুনা বিতর্কিত নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় পাওয়া যায়! বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর গত কয় বছরে তাঁদের সম্পদ বেড়েছে শত শত গুণ। এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই তাদের প্রয়োজন গণতন্ত্রবিহীন ব্যবস্থা! প্রয়োজন সর্বজনের মতপ্রকাশের ওপর খড়্গ বসানো! 

ত্বকী হত্যার বিচার করলে, খুনি-লুটেরাদের থামালে এ রকম ক্ষমতাবানদেরই সমস্যা। ক্ষমতাবানেরা আশা করেন, মানুষ এগুলো ক্রমে ভুলে যাবে। কিন্তু মনে রাখাই আমাদের লড়াই।

যেখানে মানুষ তাদের প্রিয় শীতলক্ষ্যার দিকে তাকালেই দেখে রক্ত কিংবা লাশ, দেখে ত্বকীর আগে-পরে আরও অনেক মানুষের অস্বাভাবিক অকালমৃত্যুর খুনিদের, তখন কী করে তারা ভুলে যাবে?

তাই প্রতি মাসে বিচারের দাবি নিয়ে দাঁড়ানোই মানুষের লড়াই। এই জীবন্ত প্রতিবাদে বছরের পর বছর ত্বকী হয়ে ওঠে সব অস্বাভাবিক অকালমৃত্যুর বিচারের কণ্ঠ।

ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি খুনি, লুটেরা, প্রাণবিনাশী শক্তিগুলোর চালক-পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়ায়। চায় স্বাভাবিক জীবন ও মৃত্যুর গ্যারান্টি। 

আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক