বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু তার মৃত্যু ঘটেনি। তার নাম এখন আরও জীবন্ত। আবরার জীবন্ত রাজনীতিতে, আবরার জীবন্ত নিপীড়িতের ফরিয়াদে। যার নাম আগে কেউ জানত না, সে এখন প্রতিবাদ ও দেশপ্রেমের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। নিপীড়িতরা এভাবেই তাদের বীর, তাদের নায়কের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখে। সামান্য মানুষ যখন অসামান্য প্রতীকে পরিণত হয়, তখন তাকে আর দমানো যায় না। এমন প্রতীককে ক্ষমতার ডাস্টার দিয়ে মোছাও যায় না।
আবরারকে ভোলেনি তার হত্যাকারীদের ভাই-বেরাদরেরাও। আবরারের আপন ছোট ভাই বুয়েটে ভর্তির যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়েও ভীত। কারণ, তার ভাইয়ের হত্যাকারীদের দল, তাদের সমর্থকেরা এখনো সেখানে আছে। আবরারের নাম-নিশানাও তারা রাখতে চায় না। এ জন্য প্রতিবছর যেখানেই আবরারের স্মরণসভা হয়, সেখানেই তারা হামলা করে। এ বছরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে আবরারের স্মরণসভার ডাক দিয়েছিল তুলনামূলক নবীন সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ। ছাত্রলীগের একদল যুবক সেখানে হামলা করেছে, নেতা-কর্মীদের পিটিয়েছে এবং সভা ভন্ডুল করতে চেয়ার ভেঙেছে, আবরারের ছবিওয়ালা ব্যানারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের আক্রোশ দেখে মনে হয়, তারা আবরারকে বারবার হত্যা করতে পারবে।
এক আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারে ২০ জনের ফাঁসি ও ৫ জনের যাবজ্জীবন দিলে এত এত হত্যার জন্য কত কত ফাঁসি দেওয়া লাগবে? এভাবে কি অপরাধ কমে? কমে যে না, তার প্রমাণ আবরারের হত্যাকারীদের দল থেকে আরও আরও হামলাকারীর সরবরাহ। যে অপরাধমূলক রাজনীতি একদিকে নিহত ও অন্যদিকে ঘাতক পয়দা করে, সেই রাজনীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
অর্থাৎ তারা আবরারকে এখনো ভয় পায়। কিন্তু কী করবে তারা, যখন অসংখ্য মানুষ প্রতিবছর অক্টোবর মাসে যার যার ফেসবুকে আবরারের নাম নেয়! যখন তার নাম ও ছবির ওপর দিয়ে শোক ও ক্ষোভের হাওয়া বয়ে যায়! মানুষের মন থেকে তো আবরারদের মুছে ফেলা যায় না। তারা একসময় আবরারের স্মরণে তৈরি করা স্মৃতিস্তম্ভও গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারা কি জানে না যে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদের ঘোষণা? বায়ান্নর শহীদদের স্মৃতিতে তৈরি করা মিনার যখন পাকিস্তানিরা ভেঙে ফেলেছিল, তখন তিনি লিখেছিলেন,
‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো! যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে’
ছাত্রলীগ কি বুঝতে পারছে, ইতিহাস তাদের গায়ে কোন কালিমার সিল-ছাপ্পড় লাগিয়ে দিচ্ছে? ইডেনের ভয়াবহ ঘটনাগুলো ফাঁস হওয়ার পরও তাদের হুঁশ হলো না। হেলমেট, লাঠি, হাতুড়ি, চাপাতি, রামদা, রডসহ আগ্নেয়াস্ত্রধারীদের ছবি যে ভোলে ভুলুক, ডিজিটাল বাস্তবতায় সেসব প্রমাণ চাইবামাত্রই মিলবে।
আবরার হত্যার বিচারিক রায় হয়েছে। রায়ের পরে এই নিবন্ধকার তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘রায়ে ২০ জনের ফাঁসি আর ৫ জনের যাবজ্জীবন দণ্ড হয়েছে। অনেকেই এই রায়ে খুশি। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, বিশ্বজিৎ হত্যার রায়ের পরিণতি হতে পারে এই রায়ের।…প্রশ্ন অন্যখানেও, ১ জনকে হত্যা করল ২৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী। এই ২৫ জনকে সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন কয়জন? নিশ্চয়ই তিনি কোনো ছাত্রনেতা কিংবা আরও বড় কোনো নেতা হবেন। মামলার অভিযোগপত্রে তো তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এই সাজাপ্রাপ্ত ২৫ জন আপন সিদ্ধান্তে আবরারকে চূড়ান্ত নির্মমতার সঙ্গে খুন করেছিলেন? এই রায় থেকে হত্যার চেইন অব কমান্ড পরিষ্কার হলো না। যাঁরা আবরারকে পিটিয়েছিলেন, তাঁরা হুকুম তামিলকারীমাত্র, তাঁরা হত্যা যন্ত্রমাত্র, হুকুমদাতা কে, যন্ত্রটা চালাচ্ছিল কে?’
আবরারের ছবি পুড়িয়ে তাঁর স্মরণসভায় হামলা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে হত্যাকারীরা কারাগারে থাকলেও যাঁরা তখন আবরার হত্যার আয়োজন করেছিলেন, তাঁরা এখনো বহাল তবিয়তে। আবরার চিরতরে কবরে শায়িত হলেও হত্যাযন্ত্র চালু রয়েছে। এ কারণে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে শুধু হত্যাকারীদের বিচার হলেই হত্যার মিছিল থামে না, হত্যার রাজনীতিরও বিচার হওয়া দরকার। বারবার সন্ত্রাস, হামলা, হত্যার এত ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম আসছে যে আর বলা যাচ্ছে না ঘটনা ঘটিয়েছেন বিচ্ছিন্ন কয়েকজন কর্মী ও সমর্থক। বরং একই কায়দার সন্ত্রাস-নির্যাতন এবং একই কায়দায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দমন স্পষ্ট করে যে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, এগুলো সংগঠিত কাজ। গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ জনের বেশি ছাত্র ছাত্রলীগের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে এবং এসবের পেছনে সংগঠিত শক্তি ও নেতৃত্ব রয়েছে।
আরও ভয়াবহ হলো এই, কেউ ক্ষমতাসীনদের কোনো নীতিকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী বললে তাকে রাজাকার বলা হয়, কেউ তাদের কোনো কাজের প্রতিবাদ করলে তাকে ‘শিবির’ বলা হয়। আবরারকেও ‘শিবির’ তকমা লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কতটা অমানবিক হলে কেউ এটা করতে পারে? শিবির হলো কি আর যা-ই হলো, দেশের কোনো নাগরিককে কেউ এ রকম রাজনৈতিক কারণে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে? জামায়াত-শিবির যদি এতই ভয়াবহ, তাহলে আইন করে নিষিদ্ধ করছে না সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকার?
সেই শিবির অভিযোগের ধুয়া তুলেই আবরারের স্মরণসভায় হামলা হয়েছে। আবরারের হত্যাকারীরা যে মিথ্যা অভিযোগ তুলে ছেলেটিকে হত্যা করেছিল, সেই অভিযোগ আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাদের মুখে শুনে কী মনে হবে? মনে হবে যে আবরার হত্যাকে এই হামলাকারীরাও ‘যুক্তিযুক্ত’ মনে করেন, জায়েজ মনে করেন। না হলে আবরারের হত্যাকারীদের বুলি তাদের মুখে শোভা পাবে কেন?
আবরারকে যে লাঠি-রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই একই লাঠি-রড হাতে তারা টিএসসিতে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভায় হামলা করবেন কেন?
এক আবরার ফাহাদ হত্যার বিচারে ২০ জনের ফাঁসি ও ৫ জনের যাবজ্জীবন দিলে এত এত হত্যার জন্য কত কত ফাঁসি দেওয়া লাগবে? এভাবে কি অপরাধ কমে? কমে যে না, তার প্রমাণ আবরারের হত্যাকারীদের দল থেকে আরও আরও হামলাকারীর সরবরাহ। যে অপরাধমূলক রাজনীতি একদিকে নিহত ও অন্যদিকে ঘাতক পয়দা করে, সেই রাজনীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ব্যক্তিকে দণ্ড দিয়ে রাজনীতি খালাস হতে পারে না।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
faruk.wasif@prothomalo.com